জসীম উদ্দীন (১৯০৪-১৯৭৬) বাংলা সাহিত্যে এক গুণী শিল্পীর নাম। তাঁর হাতের স্পর্শে বাংলা সাহিত্য নতুন মাত্রা পেয়েছে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে নতুন নতুন উপাদান-উপকরণ সংযোজন করেন। বাংলাকে বলা হয় সাহিত্যের আবাসভূমি। এ দেশে ছড়িয়ে রয়েছে সাহিত্যের উপাদান। আমাদের গ্রামপ্রধান দেশের অধিকাংশ সাহিত্য গ্রামে সৃষ্টি হয়েছে। জসীম উদ্দীনের ছিল জনসাধারণের প্রতি অপরিসীম মমতা ও সমবেদনাবোধ, যাকে বলা হয় পোয়েটিক হিউম্যানিজম। জসীম উদ্দীন গ্রাম্য সাহিত্যের সংস্পর্শে বেড়ে উঠেছেন, বড় হয়েছেন কাঁদামাটিকে ভালোবেসে। তাই তো ভুলতে পারেননি গ্রাম্য চাষাভূষা মানুষগুলোকে। বার বার বন্ধুত্বের বন্ধন পাকা-পোক্ত করার জন্য ছুটে গিয়েছেন গ্রামের মানুষগুলোর কাছে। তাদের জীবনের হাসি, কান্না, ভালোবাসা, বিষাদ তুলেও এনেছেন সাহিত্যে। তিনি বুঝতেন তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা। আবার হাসিতে তাদের করতে পারতেন মুখরিত।
জসীম উদ্দীনের জন্ম হয় রবীন্দ্র-নজরুল যুগে। এসময় জন্মগ্রহণ করেও রবীন্দ্র-নজরুলের বিশেষ প্রভাব তাঁর ওপর বিস্তার করতে পারেনি। তাঁর কাব্যের সাবলীলতা, সহজবোধ্যতা, একান্ত নিষ্ঠা রূপকলাব বৈভবে তিনি ছিলেন অনন্য। ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় ঘোরাফেরা করেও জসীম উদ্দীন ভুলে যেতে পারেননি সেই ডালিম গাছের তলায় মাটির সোঁদা গন্ধের কথা। ভুলে যাননি রঙিলা নায়ের মাঝিকে এবং সেই গ্রাম-জীবনের কাব্যগুরু যাদব, পরীক্ষিত, ইসমাইল, হরি পাটনী প্রমুখকে।(১) বস্তুত সমকালীন আধুনিক কবিদের মতো তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ কোনো প্রতিবন্ধকতা হয়ে আসেননি। তাই প্রতিরোধের প্রশ্নও ছিল অবান্তর।(২) এবার আমরা যদি কল্লোল যুগের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখতে পারি, এ যুগের প্রায় সব কবিই নগর চেতনায় প্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হন এবং কবিতায় নতুন নতুন বিষয়বস্তুর জন্য বিশ্বসাহিত্যের দ্বারস্থ হন, কেননা পল্লি প্রকৃতি ও লোক ঐতিহ্যের মোহন রূপ আধুনিক কবিদের মনে কোনো টান সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে সাহিত্য শিল্পের তীর্থভূমি যে এখন নগর এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন তিরিশের কবিদের মন। তিরিশের একজন কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল আমাদের জীবনের কেন্দ্র এখন সরে এসেছে শহরে। শহর এখন আমাদের জীবনকে রূপায়িত, ধ্বংস করে, পরিচর্যা করে। শহরের মধ্যে শহরের প্রাণের মধ্যে আমরা বাঁচি।(৩) কিন্তু আমরা দেখতে পাই জসীম উদ্দীন শহরে বাস করেও শহরের প্রাণের মধ্যে বাঁচতে পারেননি। বার বার ছুটে গেছেন গ্রামের জনমানুষের কাছে। সেখান থেকে লোক উপাদান ও লোক ঐতিহ্যের নানা উপকরণ সংগ্রহ করেছেন।
তাঁর লেখনীতে উপস্থিত হয়েছে বাংলার নদী, খাল-বিল, ক্ষেত-খামার, চর, জারি গান, পুঁথি পাঠ, আকাশ, মেঘ, বাংলার জনপদ, মাঠ-ঘাট, চেনা-জানা পথ, মাঠে-মাঠে সোনার ধান, মটরের সবুজ ক্ষেত, কলমির ডাঁটা, রাখাল ছেলের বাঁশি, গ্রাম্যকুমারীর স্নিগ্ধ রূপ, মুর্শিদি গান, বাঙালি সধবার মাথায় টিপ, বিবাহিতা কিশোরীর কাঁকন ও নূপুর, বাঙালির ঘরকন্না ইত্যাদি। তিনি পল্লি জীবনকে অবলম্বন করে নির্মাণ করেছেন একের পর এক সাহিত্যকর্ম। এ কবিতাগুলো গ্রামকেন্দ্রিক। তাঁর শিল্পকলমের স্পর্শে পল্লির প্রতিটি বিষয় নতুন নতুন হয়ে ধরা দিয়েছে মানুষের অন্তরে। তাই তো ডক্টর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘পল্লী বাংলা যেন অপেক্ষা করছিল এই কবির জন্য, তাঁর এই মুখপাত্রের জন্য যিনি পল্লীর কথা বলবেন, পল্লীর আবেগ ও কল্পনা নিয়ে।’(৪) জসীম উদ্দীনের অধিকাংশ কবিতায় স্থান পেয়েছে গ্রামের চাষাভূষা, নদী-নালা, ক্ষেত খামার। এ যেন কবির প্রাণ। প্রাণ না থাকলে যেমন মানুষের শরীর থাকলেও তাকে মানুষ বলা যায় না, তখন তাকে বলতে হয় মৃত। তেমনই জসীম উদ্দীনের গ্রাম হলো প্রাণ। এ প্রাণকে ছেড়ে সে কী করে হবে শহর কেন্দ্রিক। কারণ জসীম উদ্দীন গ্রামকেই ‘মক্কা হেন পবিত্র স্থান’ গণ্য করেছিলেন। গ্রাম তাঁর কাছে কোনো কনসেপ্ট নয়, একটি ফেইথ।(৫) কবি জসীম উদ্দীনের কবিতার প্রাত্র-পাত্রী গ্রাম্য চাষাভূষা লেঠেল, নিরক্ষর জনগণ। কবির অমর সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতা। যে কবিতায় কবি পল্লি-প্রকৃতির, শ্যামল-প্রতিমূর্তি, সরল, কর্ম চঞ্চল জীবনের চিত্র অঙ্কন করেছেন। এই ‘কবর’ কবিতার বয়স এবার শতবর্ষ। এটি একজন কবির জন্য পরম পাওয়া। এই বাংলার রাখাল রাজা—বাংলার মানুষের প্রাণের কবি জসীম উদ্দীনের গ্রামের বাড়ি, দেখবো বলে—২০২৫ সালের ১২ জুন অম্বিকাপুর ছুটে গিয়েছিলাম। কবি ঘুমিয়ে আছেন দাদির কবরের কাছে। তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে; যে কারণে ওখানে তাদের কবর পাহাড়া দিচ্ছে—একটি বয়স্ক ডালিম গাছ। যার বিস্তৃত শাখা-প্রশাখায় ঢেকে আছে কবির কবরসহ পরিবারের অন্যদের কবরও। কবির বাড়িতে আছে গ্রামীণ আবহ ও প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতা। এই পরিবেশ হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়—মনকে করে চঞ্চল।
কবির ছিল শক্তিশালী শিল্প মন, যে মনের মাধ্যমে কবি গ্রাম্য অতি সহজ-সরল ভাষাগুলো তাঁর শৈল্পিক মনের মিশেল ঘটিয়ে নতুন নতুন কবিতার কাঠামো তৈরি করেছেন। এই গ্রাম্য অতি সহজ-সরল মানুষের মুখের ভাষাকেই কবি কবিতার ভাষা হিসেবে নির্বাচন করেছেন এবং সেগুলোর সঠিক প্রয়োগ করেছেন। যা কবির সৃষ্টিসম্ভারের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই সহজে বোঝা যাবে। কবির ‘কবর’ কবিতাটি ‘কল্লোল’ পত্রিকায় ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর চারিদিকে হৈহৈ রব ধ্বনিত হতে থাকে। এই কবির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ‘কবর’ কবিতাটিই ছিল একমাত্র মাধ্যম। কবিতাটি তাকে রাতারাতিই খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায় এবং সবার কাছে পরিচিত করে তোলে। এ ‘কবর’ কবিতা নিয়ে জসীম উদ্দীনের নিজের বয়ান থেকেন শুনে আসা যেতে পারে, ‘তখন আমি গ্রাম্যগান সংগ্রহের কাজে প্রায়ই দীনেশবাবুকে চিঠি লিখিতাম। তাহারই এক চিঠিতে দীনেশবাবুকে লিখিলাম, ‘আপনি আমার কবিতা পড়েন না। এ মাসে ‘কল্লোলে’ আমার ‘কবর’ নামে একটি কবিতা ছাপা হয়েছে। যদি পড়েন, খুশি হব।’ চার-পাঁচদিন পর সেই চিঠির সুদীর্ঘ জবাব আসিল। দীনেশবাবু (ড. দীনেশ চন্দ্র সেন) লিখিলেন, ‘দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মতো তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে আমি অনেক চোখের জল ফেলেছি।’ ‘ফরওয়ার্ড’ খুলিয়া দেখিলাম ‘অ্যান ইয়ং মহমেডান পোয়েট’ নাম দিয়া দীনেশবাবু আমার উপরে এক প্রকাণ্ড প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। সেই প্রবন্ধে তিনি নজরুল ইসলামের কবিকৃতির উপর আলোচনা করিয়াছেন। তাঁহার পরেই আমার নাম উল্লেখ করিয়াছেন। ‘কল্লোলে’ প্রকাশিত আমার সেই ‘কবর’ কবিতাটির উচ্ছাসিত প্রশংসা করিয়া তার অংশ বিশেষ অনুবাদ করিয়া দিয়াছেন। দীনেশবাবুর নিকট হইতে একখানা পত্র পাইলাম ‘তোমার ‘কবর’ কবিতাটি নকল করে শীঘ্র পাঠাবে। আমার কাছে যে কবিতাটি ছিল তা নানা কাগজপত্রের মধ্যে কোথায় গেছে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।’ আমি কবিতাটি নকল করিয়া তাঁহাকে পাঠাইয়া দিলাম। দীনেশবাবু আর কোন উচ্চবাচ্য করিলেন না। কয়েকমাস বাদে দীনেশবাবু আমাকে লিখিলেন, ‘তোমার কবিতাটি ম্যাট্রিক ক্লাসের পাঠ্য হয়েছে। আমার যতদূর জানা আছে, পৃথিবীর কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রের লেখা এ পর্যন্ত পাঠ্য হয় নাই।’ (জসীম উদ্দীন স্মরণে স্মরণীবাহী, বসুমতি, কলিকাতা-১৯৭৪)। এই ছিল ‘কবর’ কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার নেপথ্যের ঘটনা, যা কবি নিজে বলে গেছেন। এটি সত্যিই একজন কবির জন্য বিস্ময়কর। এর চেয়ে আনন্দের কী আর হতে পারে—এর চেয়ে বড় পুরস্কার কী হতে পারে? প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখান করে তিনি তো সম্মানিত হয়েছিলেন। কেননা সময় থাকতে তাকে কেউ মূল্যায়ন করেনি। পুরস্কার তো তিনি সেদিনই পেয়েছেন; যেদিন হাজার হাজার পাঠক এই কবর কবিতা পড়ে চোখের জল ঝরিয়েছেন। সেই দিনই তো কবির কপালে জুটেছে এই মহৎ পুরস্কার—এই ভাগ্য নিয়ে ক’জন কবি জন্মেছেন এই পৃথিবীতে।
কবিতাটি জসীম উদ্দীনের বেদনাময় গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। কবিতাটিতে একটি পরিবারের বেদনাময়-করুণ মৃত্যুর বর্ণনা দাদা তার নাতির কাছে বর্ণনা করছেন। মৃত্যুর শোক বর্ণনা করেছেন, যাদের মধ্যে স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনি এবং কন্যা অন্তর্ভুক্ত। সবাই এই কবিতাকে শোকের কবিতা বললেও ঠিক এটা শোকের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনের বাস্তবচিত্র। ১১৮ লাইনের কবিতার মধ্য দিয়ে মানব জীবনের সাময়িকতা, পারিবারিক বন্ধন এবং মৃত্যু যে একদিন আসবে—কবি তার নিশ্চয়তার যে মর্মস্পর্শী আকুলতা অনুভব করেছেন। কবিতাটি কবিকে যেন অন্যধারার কবি হিসেবে চিহ্নিত করে তুলেছে, যা প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সুধী সমাজের কাছে পরিচিত করে তোলে। যা একজন কবির জন্য পরম পাওয়া। যে কারণে কবি সম্পর্কে আনিসুজ্জামান বলেন, ‘সচেতন অলংকরণের প্রয়াস থেকে নিবৃত্তি, আবেদনের প্রত্যক্ষতা এবং আঞ্চলিক স্বাদগন্ধ—গোবিন্দচন্দ্র দাসের আঞ্চলিক আবহের চেয়েও কিছু অধিক—কবিতাটিকে আলাদা করে দিয়েছিল বাংলা কবিতার মূলধারা থেকে—তা সে রাবীন্দ্রিক বা আধুনিক যা-ই হোক না কেন।’ (জসীম উদ্দীন, আনিসুজ্জামান)।
কবির প্রতি সমালোচকেরা আঞ্চলিকতার তকমা লাগিয়ে তাকে ‘পল্লীকবি’ বলে পরিচিত করে তুলতে চেয়েছেন। এই পরিচয়ে তিনি পরিচিতি পেলেও তথাকথিত আধুনিকতা বলতে যা বোঝায়—তারা তাকে আউট সাইডার করে রাখতে চেয়েছেন বার বার। কিন্তু তাকে যতই আড়াল করতে চেয়েছেন; তিনি ততই বিকশিত হয়েছেন। জসীম উদ্দীনের কবিতায় প্রকৃতি, গ্রামীণ সমাজ কিংবা সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন যেভাবে উঠে এসেছে; তা অন্য কবির কবিতায় প্রকাশিত হয়নি। মায়ের ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনস্পর্শী সামাজিকতারও বহিঃপ্রকাশ এ কবিতায়। কবিদের মধ্যে সব থেকে বেশি আধুনিক কবি জসীম উদ্দীন। আজ আমরা উত্তরাধুনিকতা বলে চিৎকার করি—সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণও রয়েছে জসীম উদ্দীনের কবিতায়। এ কবিতা আমাদের শেকড়ের কাছে নিয়ে যায়—চিনিয়ে দেয় নিজের অস্তিত্ব।
‘কবর’ কবিতায় কবি বাস্তবতাকে প্রকাশ করেছেন। এটি শুধু একটি কবিতা নয়—গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। এ কবিতা আমাদের আবেগ কিংবা অনুভূতিরও প্রকাশ ঘটায়। মানুষের আনন্দময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে একটি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে—সেখানে শোকের ছায়া নেমে আসে। একটি আনন্দের সংসারকে মুহূর্তের মধ্যেই অন্ধকারের দিকে ধাবিত করতে পারে মৃত্যু। এই মৃত্যুর চেয়ে সত্য তো দুনিয়াতে আর কিছু নেই।
একজন মৃত্যু পথযাত্রী যার ক্ষণেকে ক্ষণেকে মৃত্যুর কথা মনে পড়ে—যার কাছে জীবনটা প্রতি মুহূর্তে বিপজ্জনক মনে হয়। সেই মানুষের সামনে তরতাজা প্রাণ আজ চলে যাচ্ছে; এগুলো তার কাছে কতটা কষ্টের এবং বেদনার হতে পারে? দুঃস্বপ্নময় জীবনেও তাকে আজ বেঁচে থাকতে হয় হাজারো দুঃখ-কষ্টকে হৃদয়ে লালন করে। জীবনকে আজ ভারী মনে হয়। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের মতো ভারী আর কিছু হয় না। সবকিছু আজ মেনে নিয়েই বৃদ্ধ পিতার জীবন অবসান হয়তো এভাবেই হবে। যে কারণে তিনি বলেন, ‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে/ অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে’।
দেশের মাটির রূপ-রস আর সোঁদা-মাটির গন্ধের বর্ণনা কবি যেমন করে দিতে পেরেছেন; সেভাবে অন্য কেউ দিতে পারেননি। একটি ক্যানভাসে একটি গ্রামের বাস্তবজীবনের ছবি এঁকেছেন। এই কবিতার কাছে গেলেই যেন জীবন্ত বৈচিত্র্যময় গ্রামকে দেখতে পাই। তিনি যেন সবকিছুকে জীবন্ত করে তুলতে পারেন। গ্রামীণ মানুষের ভালোবাসা নিখাদ। যে সময়ের ছবি কবি এঁকেছেন; সে সমাজের যাতায়াত, রাস্তা-ঘাট এতটা উন্নত ছিল না। তিনি ব্যাগ কাঁধে করে ঘুরেছেন গ্রাম-গ্রামান্তরে। প্রকৃতির কোলঘেঁষে বড় হওয়া কবির নাম জসীম উদ্দীন। ‘কবর’ কবিতাটি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’তে স্থান পায়। এ গ্রন্থ প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূয়সী প্রশংসা পান। সবাই যখন রবীন্দ্রবলয়ে ভাসিয়ে দিয়ে নিজেকে লীন করে দিচ্ছেন; সেই সময় জসীম উদ্দীন নিজেদের দাঁড় করাচ্ছেন ভিন্ন পথে। কবিতায় সৃষ্টি করেছেন আলাদা স্বর।
গ্রামীণ জীবনের চিত্র ‘কবর’ কবিতায় তুলে ধরেছেন—এ যেন আমাদের বড় হওয়া, একটি জানাশোনা পরিবারের কাহিনি। প্রতিটি গ্রামের চিত্র একসময় একই রকম দেখা যেত। বাঁশ বাগান কিংবা আম বাগানের ভেতরে কবর দেওয়া হতো। এটি যেন আমাদের গ্রামীণ জীবনের একটা অনুষঙ্গ। কবর মানেই কোনো বাগানে দিতে হবে আবার যাদের জমির স্বল্পতা ছিল বা আছে তারা ঘরের কোণে কবর দেন কিংবা তাদের বাড়ির আঙিনায় কবর দিয়ে থাকেন। যে কারণে কবি তাঁর কবিতায় যে বৃদ্ধের বয়ানে একটা গ্রামীণ পরিবারের বর্ণনা করছেন, তা ওই গ্রামীণ জীবনেরই প্রতিনিধিত্ব করে। বৃদ্ধ তো এ সমাজেরই মানুষ; যে কারণে তিনিও একই কথা বলছেন তার নাতিকে—
‘এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’
কত আবেগ নিয়ে কিংবা ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে কথাগুলো বলা হয়েছে। সে সময় মানুষের মধ্যে খাঁটি ভালোবাসা ছিল। সবাই পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসতো। ভালোবেসে কেউ কাউকে ঘরে তুলে আনলে তার প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতাবোধও সারাজীবন স্বীকার করতেন। যে কারণে বৃদ্ধ তাঁর ভালোবাসার মানুষের সম্পর্কে বলেন—
‘এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতো মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইতো বুক।’
কত সরল-সহজ ছিল মানুষের জীবন। একসময় হাট-বাজারগুলো মানুষের মিলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল। অনেকে অনেক কিছু বিক্রি করতে যেতেন। আবার অনেকে অনেক কিছু কেনার জন্য যেতেন। কবিতায় কবি বলেছেন—
‘শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু’পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধ্যাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!’
তখন অর্থনীতি ভালো না হলেও মানুষ অল্প অল্প করে সঞ্চয় করতেন। যে কাজটি করেছেন কবিতার প্রধান চরিত্র। যিনি তরমুজ বিক্রি করে অল্প অল্প করে টাকা সঞ্চয় করতেন। তা থেকে স্ত্রীর জন্য পুঁতির মালা নিতেন। তামাক এবং মাজন নিয়ে যেতেন। এসব দেখে দাদি কী যে খুশি হতেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
এ কবিতায় এক বৃদ্ধ তাঁর দৌহিত্রের কাছে একের পর এক পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর কারণ বর্ণনা করে যাচ্ছেন—
‘এইখানে তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদি ঘর পেয়ে।
এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে,
হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে
অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।’
গ্রামীণ জীবনের বড় অস্বস্তি আর বেদনার জায়গা স্বামীর বাড়ি। স্বামীর বাড়িতে একজন নারীকে নানাভাবে নির্যাতিত হতে হয়। এটি তারা শারীরিকভাবে যতটা না করে; তার চেয়ে বেশি করে মানসিকভাবে। যা একজন মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। এ চিত্র গ্রামীণ জীবনের অধিকাংশ পরিবারের।
কবি গ্রামীণ জীবনকে অন্তরে ধারণ করেছেন। তাঁর মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। তিনি ড. দীনেশচন্দ্রের কাছ থেকে শিখেছেন কীভাবে গীতিকা সংগ্রহ করতে হয়। তিনি যে ঝোলা কাঁধে করে লোকজনের বাড়ি বাড়ি গেলেন; তখন গ্রামের মানুষেরা হয়ে গেলেন জসীম উদ্দীনের আপন। ‘কবর’ কবিতায় কী নিপুণভাবে বর্ণনা দিয়েছেন—বৃদ্ধের মেয়ে সাপে কেটে মারা যাচ্ছে, পুত্রের মৃত্যু ঘটছে চোখের সামনে। এ মৃত্যু যেন কেউ মেনে নিতে পারেননি। এমনকি গোয়ালের গরুও তার মালিকের জন্য চোখের জল ঝরাচ্ছে।
‘আথালের দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।’
মৃত্যু তো স্বাভাবিক ঘটনা। তবুও আমরা মানতে পারি না। প্রিয়জনের বিয়োগে আমরা রিক্ত হয়ে বসে থাকি। ঝরাতে থাকি অশ্রু। তাই তো কবিতায় আছে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষ মারা গেলেও স্মৃতি নিয়ে অন্যরা বেঁচে থাকে। এই বাঁচার মধ্যে থাকে এক ধরনের প্রজ্ঞা। এই যে জীবনের অভিজ্ঞতা, এটাই আমাদের পরম সম্পদ।
কবি জসীম উদ্দীনের মনও এক রাখালের মন। তাই তো বলেছিলেন, ‘আমাদের যা আছে তার উপরই নতুন সৃষ্টি করিতে হইবে। পুরাতনের ভিতর যে মণি মাণিক্য আছে তাহা ঘসিয়া মাজিয়া লোকচক্ষুর গোচর করিতে হইবে।’(৬) তিনি তাঁর রাখাল মনকেই বাস্তবের রং-মসলা মিশিয়ে জীবন্ত করে তুলেছেন। কবর কবিতার বৃদ্ধের চরিত্রের মধ্য দিয়েই নিজের কাব্যে মিশে একাকার হয়ে আছেন। বৃদ্ধের মাধ্যমে আমরা আবিষ্কার করতে পারি, কবির মানবকেন্দ্রিক সহজ-সরল শিল্পমানস ভাবনা। সে ভাবনার মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন কাল-কালান্তরে। তিনি মরে গিয়েও জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন মানব ক্যানভাসে। কবিকে দিয়েছে অমরত্বের স্বাদ। আমরা একশ বছর পরেও কবির গ্রামীণপ্রীতি কিংবা মা-মাটির প্রেম নিয়ে কথা বলছি। যা কোনো উপমার মাধ্যমেই বিশ্লেষণ করা যায় না। হৃদয়ে ঠাঁই দিয়ে মহিমান্বিত করা যায়। তাই ওয়ার্ড সওয়ার্থের মতো করে বলতে হয়—Spotanious overflow of powerful feelings না থাকলে জসীম উদ্দীন চরিত্রগুলো সৃষ্টি করতে পারতেন না। এখানেই কবি হিসেবে তাঁর মহত্ব।
তথ্যগ্রন্থ
১. জীবন কথা (১ম খণ্ড), জসীম উদ্দীন, ৩য় সংস্করণ, ১৯৭৬
২. শিল্পীর রূপান্তর, আবু হেনা মোস্তফা কামাল
৩. হঠাৎ আলোর ঝলকানি, বুদ্ধদেব বসু, পৃষ্ঠা ১৬
৪. অনতিক্রান্ত বৃত্ত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
৫. জসীম উদ্দীনের রাখালী ও নকশি কাঁথার মাঠ, তিতাস চৌধুরী
৬. জীবন কথা, জসীম উদ্দীন, ১ম খণ্ড, ৩য় সংস্করণ, ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ৩১।