১৯৫০ সালে, যদিও আমেরিকান সরকার তখনো তা বুঝতে পারেনি, তাদের হাতে ছিল স্নায়ুযুদ্ধ জয়ের একটি চাবিকাঠি ড. শিয়ান শুইসেন। এক অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন চীনা রকেট বিজ্ঞানী যিনি ইতিমধ্যে মহাকাশবিজ্ঞান ও অস্ত্রপ্রযুক্তির ক্ষেত্র বদলে দিয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি এবং এমআইটি-এর গবেষণাগারে তিনি জেট প্রপালশনের রহস্য সমাধানে সাহায্য করেন এবং আমেরিকার প্রথম নির্দেশনাযুক্ত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেন। তিনি মার্কিন বিমানবাহিনীর একজন কর্নেল হন, ম্যানহাটন প্রকল্পে কাজ করেন এবং নাৎসি বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জার্মানিতে পাঠানো হয়।
ড. শিয়ান চেয়েছিলেন প্রথম মহাকাশচারী যেন একজন আমেরিকান হন—এবং সে লক্ষ্যেই তিনি একটি রকেট ডিজাইন করছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ করে সব থেমে যায়। তাঁর ক্যারিয়ারের শীর্ষবিন্দুতে হঠাৎ একদিন তাঁর দরজায় কড়া নাড়ে এফ.বি.আই। তাঁকে তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্রের সামনে হাতকড়া পরিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও পরে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ বা গুপ্তচরবৃত্তির কোনো প্রমাণ মেলে না এবং অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়, তবুও আমেরিকা তাঁকে বহিষ্কার করে—১৯৫৫ সালে প্রায় এক ডজন আমেরিকান যুদ্ধবন্দির বিনিময়ে তাঁকে কমিউনিস্ট চীনে ফিরিয়ে পাঠানো হয়।
এই একটি বহিষ্কারের ফলাফল ছিল বিপুল। শিয়ান চীনে ফিরে গিয়ে মাও জেদংকে রাজি করান তাঁকে আধুনিক অস্ত্র কর্মসূচিতে যুক্ত করতে। দশকের শেষ নাগাদ চীন তাদের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে। ১৯৮০ সালের মধ্যে, চীন সহজেই ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা মস্কোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে সক্ষম হয়ে ওঠে। শিয়ান কেবল চীনের ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশ কর্মসূচির জনক হিসেবে পরিচিত নন; তাঁর হাত ধরে যে প্রযুক্তিগত বিপ্লব শুরু হয়, তা চীনকে এক মহাশক্তিতে রূপান্তর করে।
আজকের দিনে যখন চীনা ছাত্র ও গবেষকদের টার্গেট করে মার্কিন প্রশাসনের কড়া নীতি দেখা যাচ্ছে, তখন এই ইতিহাস আবারও মনে করিয়ে দেয় কীভাবে আমেরিকার এক ভুল সিদ্ধান্ত বিশ্ব রাজনীতির চালচিত্র পাল্টে দেয়। ২০২০ সালের দিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ঘোষণা করেন, চীনা ছাত্রদের ভিসা "আক্রমণাত্মকভাবে বাতিল" করা হবে যদি তাদের চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগসূত্র থাকে অথবা তারা "সমালোচনামূলক" ক্ষেত্রে পড়াশোনা করে। বর্তমানে আমেরিকায় প্রায় ১০ লাখ বিদেশি ছাত্র রয়েছে, যার মধ্যে ২.৫ লাখের বেশি চীনা। ড. শিয়ানের বহিষ্কার এক সতর্কবার্তা হিসেবে থাকা উচিত।
ম্যাকার্থির লাল আতঙ্কের সময় চিয়ান শুধু একজন চীনা এবং একজন বিজ্ঞানী বলেই সন্দেহের চোখে পড়েন। তাঁর নিরাপত্তা ছাড়পত্র কেড়ে নেওয়া হয়, তাঁকে অপমান করা হয়। আমেরিকা শুধু মহাকাশ প্রতিযোগিতায় সোভিয়েতদের পেছনে পড়ে যায়নি, বরং চীনকে এমন একটি সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছিল যার সাহায্যে তারা আমেরিকার প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
১৯৫০ সালে এক অভিবাসন শুনানিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছিল, ড. শিয়ান শ্যুসেনকে (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) নির্বাসিত করা হবে কি না। ছবি: লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস ফটোগ্রাফিক আর্কাইভ/ইউসিএলএ লাইব্রেরি স্পেশাল কালেকশনস।
ড. শিয়ান ২৩ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসেন। তিনি এমন একটি বৃত্তির সুবিধা পান যা তখনকার একটি দর্শনকে প্রতিফলিত করত; আন্তর্জাতিক শিক্ষাবিনিময়ই বিশ্ব শান্তি এবং মার্কিন মূল্যবোধের প্রসারের উপায়। তাঁর মতো অনেক প্রতিভাবান ছাত্র এই কর্মসূচির মাধ্যমে আমেরিকায় পড়তে এসেছিলেন। ১৯৬০-এর দশকে, চীনের ২০০ জন প্রধান বিজ্ঞানীর মধ্যে তিন-চতুর্থাংশই আমেরিকায় পড়াশোনা করেছিলেন।
ক্যালিফোর্নিয়ায় তিনি আরও কিছু উদ্যমী বিজ্ঞানীর সঙ্গে "সুইসাইড স্কোয়াড" নামে একটি দল গঠন করেন—যাদের এক পরীক্ষায় একবার গোটা ল্যাব উড়িয়ে দিয়েছিল। পরে তারা “জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি” নামে সরকারি স্বীকৃতি পায়, যা আজকের নাসা-র পূর্বসূরি।
১৯৪৯ সালে শিয়ানকে এই ল্যাবের পরিচালক করা হয়। তাঁর পরিকল্পনা ছিল শুধু মহাকাশ জয় নয়, রকেট প্রযুক্তি দিয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস এক ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা সম্ভব করা।
তিনি কি গুপ্তচর ছিলেন? কমিউনিস্ট? কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কখনোই পাওয়া যায়নি। এমনকি জে. রবার্ট ওপেনহাইমারের মতো বিশিষ্ট বিজ্ঞানীও তাঁর পক্ষে কথা বলেছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। পাঁচ বছর গৃহবন্দিত্বে থাকার পর, চিয়ান চীনা সরকারের কাছে আমেরিকা থেকে তাকে উদ্ধার করার আকুতি জানান।
রাষ্ট্র বিভাগের এখন ডিক্লাসিফায়েড করা নথিপত্রে দেখা যায়, শিয়ানকে আমেরিকার চোখে প্রায় মূল্যহীন পিওন বানানো হয়েছিল। চীনের প্রধানমন্ত্রী ঝৌ এনলাই বলেন, ‘আমরা শিয়ান শুইসেনকে ফিরে পেয়েছি—এই অর্জনেই আলোচনাটি সার্থক।’
শিয়ান আর কখনো আমেরিকায় ফিরে আসেননি। তিনি চীনে কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে বাকি জীবন কাটান। সেখানে তিনি জাতীয় নায়ক হিসেবে সম্মানিত হন এবং তাঁর নামে একটি জাদুঘর নির্মিত হয়। তাঁর পরবর্তী কথাবার্তাগুলোর বেশিরভাগই ছিল প্রযুক্তিগত দলিল কিংবা আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রচারণা।
তবে ১৯৬৬ সালে, তাঁর এক সাবেক সহকর্মী একটি চীনা ফুলের চিত্রসহ একটি পোস্টকার্ড পান, যার পেছনে চিয়ান লিখেছিলেন, ‘এটি সেই ফুল, যা প্রতিকূলতায় ফোটে।’
বর্তমানে যখন বিদেশি ছাত্রদের প্রতি সন্দেহ ও বাধা বাড়ছে, তখন শিক্ষা এবং বিনিময়ের যে কৌশলগত সুফল একসময় আমেরিকার ছিল—তা হারিয়ে যেতে বসেছে। ড. চিয়ানের সাফল্য মনে করিয়ে দেয়; যদি আমেরিকা মেধাকে স্বাগত না জানিয়ে, তাকে ঠেলে দেয়, তবে সেই প্রতিভাই একদিন তার বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে।
লেখক: ক্যাথলিন কিংসবারি, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতামত বিভাগের সম্পাদক।
সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস