বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি

পাঁচ মাসে ১৫৮৭ হত্যা মামলা

বিশেষ প্রতিবেদন
  ১৭ জুন ২০২৫, ১২:৫৩

দেশে খুনাখুনি বেড়েই চলেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের গত পাঁচ মাসের অপরাধসংক্রান্ত পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় এক হাজার ৫৮৭টি হত্যা মামলা করা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে হত্যা মামলা হয়েছিল এক হাজার ২৬৫টি। এই হিসাবে গত বছরের চেয়ে এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৩২২টি বেশি হত্যা মামলা করা হয়েছে।
শতকরা হিসাবে তা বেড়েছে ২০ ভাগ। তথ্য বিশ্লেষণ করে এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসের হিসাব ধরে দেখা গেছে, দিনে গড়ে ১০ জন খুন হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে হত্যা মামলা হয় ২৯৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০টি, মার্চে ৩১৬টি, এপ্রিলে বেড়ে হয় ৩৩৬টি এবং মে মাসে তা আরো বেড়ে হয় ৩৪১টি। এই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে দেশে ৩১৭ জনকে হত্যা করা হয়।
অন্যদিকে দেশে গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসে হত্যা মামলা হয়েছিল এক হাজার ২৬৫টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে হয় ২৩১টি, ফেব্রুয়ারিতে ২৪০টি, মার্চে ২৩৯টি, এপ্রিলে ২৯৬টি এবং মে মাসে ২৫৯টি। এ হিসাবে গত বছরের একই সময়ে গড়ে মাসে হত্যার শিকার হয় ২৫১ জন করে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসের মামলায় আগের ২৫৫টি মামলা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই সংখ্যা বাদ দিলেও গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসের চেয়ে এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে খুনের মামলা বেড়েছে।
নিহত বেশি বিএনপির নেতাকর্মী : হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় দেশে ৬৭ ব্যক্তি হত্যার শিকার হয়। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩২৫টি রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয় ৪৭ জন। বাকি ২০ জন এপ্রিল ও মে মাসে নিহত হয়।
সংগঠনটির সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ, চাঁদাবাজি এবং বিভিন্ন স্থাপনা দখলে সহিংসতা বেশি ঘটেছে।
এইচআরএসএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথম তিন মাসে সংঘটিত ৩২৫টি সহিংসতার মধ্যে ১৯০টি ঘটে বিএনপির অন্তঃকোন্দলে। জানুয়ারি থেকে মে মাসের সহিংসতায়ই বিএনপির ৪৫ জন, আওয়ামী লীগের ১০ জন, জামায়াতের একজন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের একজন এবং ইউপিডিএফের দুজন নিহত হন। অন্য দুজনের রাজনৈতিক পরিচয় জানা যায়নি। পরের দুই মাসে আরো রাজনৈতিক কর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাতেও বিএনপির নেতাকর্মী নিহতের ধারাবাহিকতার তথ্যচিত্র পাওয়া গেছে।  
উল্লিখিত পাঁচ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৭০ জন গুলিবিদ্ধ হয়। চার শতাধিক বাড়িঘর, রাজনৈতিক কার্যালয়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। 
সংগঠনটি বলছে, দেশে গণপিটুনিতে উল্লিখিত পাঁচ মাসে ৫৩ ব্যক্তি নিহত হয়।
রাজধানীতে রাজনৈতিক খুন ৩৯ শতাংশ : পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ঢাকা রেঞ্জে ৩৭৬টি হত্যা মামলা করা হয়েছে। গত বছর ঢাকা রেঞ্জে নিহত হয় ২৯৯ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৫৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫৪ জন, মার্চে ৬০ জন, এপ্রিলে ৭৫ জন এবং মে মাসে ৫১ জন নিহত হয়।
ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় হত্যা মামলা করা হয় ১৬৮টি। রাজধানীতে সংঘটিত এসব হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৩৯ শতাংশই ঘটেছে রাজনৈতিক কারণে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে রাজধানীতে ১৬৮টি হত্যা মামলা করা হয়। ২০২৪ সালের একই সময়ে এসংক্রান্ত মামলা করা হয় ৬৩টি। তাতে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় একই সময়ে হত্যা মামলা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। পূর্ববিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিভিন্ন হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ভাড়াটে সন্ত্রাসীরাও অর্থের বিনিময়ে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত হচ্ছে। ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তৎপর রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুলক হক বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে হত্যার ঘটনা ঘটছে। অন্যান্য অপরাধমূলক ঘটনাও ঘটছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, পুলিশকে মাঠে আরো সক্রিয় হতে হবে। তাহলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কমে আসবে।
গত রবিবার সচিবালয়ে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। পুলিশ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়।
আইজিপি বাহারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অপরাধ প্রতিনিয়ত বাড়ে আবার কমেও। তবে আমরা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। অপরাধীদের ধরতে অভিযান চলছে।’
অহরহ খুন : পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে দিনে গড়ে ১০টি হত্যাকাণ্ড ঘটছে। কালের কণ্ঠের সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিনিধিরা স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে জানিয়েছেন, চলতি বছরের প্রথম সাড়ে পাঁচ মাসে ময়মনসিংহে ৪৪, কুমিল্লায় ৪২, সিরাজগঞ্জে ৩৮, নারায়ণগঞ্জে ৩১ এবং ঝিনাইদহে ২৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জে ২৭, নেত্রকোনায় ২৭, যশোরে ২৪, নওগাঁয় ২৩, ফরিদপুরে ২১, শেরপুরে ২১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২০, মুন্সীগঞ্জে ১৭, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৫, নাটোরে ১৫, বরিশালে ১৪, শরীয়তপুরে ১৩, বাগেরহাটে ১৪, খাগড়াছড়িতে ১৪, জয়পুরহাটে ১৩, লক্ষ্মীপুরে ১২, মৌলভীবাজারে ১২, বরগুনায় সাত, জামালপুরে আট, গোপালগঞ্জে সাত, চুয়াডাঙ্গায় চার, কুড়িগ্রামে ছয়, মেহেরপুরে সাত এবং রাঙামাটিতে সাতটি হত্যাকাণ্ড ঘটে।
গতকাল সোমবার ঝিনাইদহ সদর উপজেলার শঙ্করপুরে ছেলের কোদালের আঘাতে শাহাদাত হোসেন (৬৫) নামের এক কৃষক নিহত হন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পারিবারিক জমিতে কাজ করার সময় এ ঘটনা ঘটে। সকালে বাবা-ছেলে মিলে মরিচের ক্ষেতে কাজ করতে যান। হঠাৎ কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে ফয়সাল ক্ষিপ্ত হয়ে হাতে থাকা কোদাল দিয়ে বাবার মাথায় সজোরে আঘাত করেন। ঘটনাস্থলেই মারা যান শাহাদাত হোসেন। এলাকাবাসী ফয়সালকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে।
গত রবিবার যশোরের অভয়নগর উপজেলার সিদ্ধিপাশা ইউনিয়নের নাউলি গ্রামে হাসান শেখ (৩০) নামের কুয়েতফেরত এক যুবককে জবাই করে হত্যা করা হয়। ওই দিন সকালে গ্রামের একটি মাছের ঘেরপার থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত হাসান শেখ গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে। আট বছর কুয়েতে প্রবাসজীবন কাটিয়ে আড়াই মাস আগে দেশে ফেরেন। দুই মাস আগে বিয়েও করেন তিনি। এ হত্যাকাণ্ডের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাগর, জামিল ও চঞ্চল নামের তিন যুবককে আটক করেছে পুলিশ। অভয়নগর থানার ওসি (তদন্ত) শুভ্র প্রকাশ দাস বলেন, তদন্তের মাধ্যমে হত্যার রহস্য উদ‌ঘাটনের চেষ্টা চলছে। গত শনিবার বগুড়ায় স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় রিকশাচালক বাবাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতের নাম শাকিল মিয়া। ওই দিন বিকেলে শহরের ফুলবাড়ী মধ্যপাড়া করতোয়া নদীর ঘাটসংলগ্ন এলাকায় তাঁকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিতু ইসলামকে (৪৩) প্রধান আসামি করে ১৭ জনকে আসামি করে এ ব্যাপারে গত রবিবার বগুড়া সদর থানায় মামলা করেছেন নিহত শাকিলের স্ত্রী মালেকা বেগম। পুলিশ জিতু ইসলাম, তাঁর দুই সহযোগী শফিকুল হাসান (২৮) ও মতিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলার প্রধান আসামি জিতু ইসলামের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় শাকিলকে হত্যা করা হয়েছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সরকার মুকুল বলেন, সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে জিতুকে বহিষ্কারের সুপারিশ করে কেন্দ্রে চিঠি পাঠানো হলে ওই রাতেই জিতু ইসলামকে বহিষ্কার করা হয়। শাকিলের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলে পড়লে তিনি বলছিলেন, ‘তোমরা আমাকে মেরো না, মাফ করে দাও, মেয়েকে বিয়ে দিব।’ তবে শেষ রক্ষা হয়নি শাকিলের। কালের কণ্ঠের বগুড়ার নিজস্ব প্রতিবেদক গত সোমবার নিহত শাকিলের বাড়িতে গেলে শাকিলের মা সাদিয়া বলেন, ‘কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের?’ শাকিলের একমাত্র বোন আশা খাতুন বলেন, ‘ঘটনার দিন দুপুর ১২টায় বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে ভাইকে নিয়ে যায় জিতু ও তার লোকজন।’
রাজধানীতেও একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। গত মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর দক্ষিণখানের শাহ কবীর মাজার রোডের চালাবন এলাকায় রাস্তায় প্রকাশ্যে শিল্পী বেগম নামের এক নারীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। গত বুধবার দুপুরে পল্লবী ১১ নম্বর সেকশনের ৩৫ নম্বর বাসার পঞ্চম তলায় নাজমুল হাসান পাপ্পু ও দোলনা আক্তার দোলা নামের এক দম্পতি নিজ বাসায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। একই দিন রাজধানীর কমলাপুরে সি-ল্যান্ড আবাসিক হোটেলের ছয়তলার একটি কক্ষ সুমি রায় নামের এক নারী খুন হন। এভাবেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুনের ঘটনা ঘটছে।