হোয়াইট হাউসে এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্যনীতি আরও কঠোর ও একমুখী হয়ে উঠেছে। শঙ্কা এখন আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নশীল দেশগুলোর রপ্তানিকারক ও কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই শঙ্কার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ট্রাম্পের ঘোষিত “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি, যার ফলে আমদানির ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ, বহুজাতিক বানিজ্য চুক্তিতে অনীহা, এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে প্রণোদনার মতো নানা সিদ্ধান্ত আসতে শুরু করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য এটা কী কোনো বিপর্যয় ডেকে আনবে?
সংক্ষেপে বললে—না। বরং এটা হতে পারে আমাদের অর্থনীতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাবার একটি সুযোগ। আতঙ্ক নয়, বিশ্লেষণ দরকার। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই পণ্যের অন্যতম বড় ক্রেতা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অতএব যুক্তরাষ্ট্র যদি রপ্তানির ওপর শুল্ক বাড়ায়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু প্রভাব পড়বে—এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এটিকে ভয়াবহ সংকট হিসেবে চিহ্নিত করার আগে আমাদের বুঝতে হবে, এই নীতি সবার জন্য প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ চীন, মেক্সিকো, ভারত, ভিয়েতনাম—সব দেশকেই একইভাবে শুল্কের বেড়াজালে পড়তে হচ্ছে।
এই সমতাভিত্তিক চাপের ভেতরেও সুযোগ লুকিয়ে আছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি পণ্য গুণগত মান, সরবরাহ চেইন এবং রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রাখতে পারে, তাহলে কিছুটা হলেও ছাড় আদায় করা সম্ভব। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো—বিকল্প বাজার ও পণ্যে বৈচিত্র্য আনাই হতে পারে মূল কৌশল।
রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণ সময়ের দাবি। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় তৈরি পোশাক একচেটিয়া আধিপত্য করে আসছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে অন্য খাতগুলোকেও তুলনামূলক গুরুত্ব দেওয়ার। তথ্য প্রযুক্তি, ওষুধ শিল্প, কৃষিপণ্য, হালকা প্রকৌশল, চামড়া ও জাহাজ নির্মাণ—এই খাতগুলোতে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন শুল্কনীতি যদি পোশাক রপ্তানির ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তাহলে এই বিকল্প খাতগুলোই হতে পারে নতুন চালিকাশক্তি।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ গ্লোবাল আইসিটি আউটসোর্সিংয়ের একটি নির্ভরযোগ্য গন্তব্য হয়ে উঠছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ওষুধ রপ্তানি বাড়ছে। কৃষিপণ্যে যেমন আম, শাক-সবজি, মাছ—এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে মার্কেট ধরছে। সরকার যদি এই খাতগুলোতে রপ্তানি সহায়ক নীতিমালা গ্রহণ করে, তাহলে শুল্ক চাপের নেতিবাচক প্রভাব অনেকটাই প্রশমিত হবে।
কূটনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন দরকার। ট্রাম্পের শুল্কনীতি রাজনৈতিক—এটা ব্যবসায়িক কোনো হিসাব-নিকাশের ফল নয়। অতএব প্রতিক্রিয়া জানাতে হলেও রাজনৈতিক-কূটনৈতিক কৌশল দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা, কংগ্রেস ও সিনেটের বাংলাদেশ মিত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ, প্রবাসী বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো—এসব কৌশল দীর্ঘমেয়াদে শুল্ক ছাড় পাওয়ার জন্য সহায়ক হতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও কমিউনিটি নেতারা একযোগে আওয়াজ তুললে মার্কিন প্রশাসনের নীতিনির্ধারকদের উপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব। এর নজির অতীতে বহুবার দেখা গেছে।
গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে বাংলাদেশের অবস্থান মজবুত করা জরুরি। বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন এক নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এই অঞ্চলের বিকল্প উৎস হিসেবে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতকে বিবেচনায় নিচ্ছে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যদি অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি সরবরাহ, দক্ষ জনবল, বন্দর সুবিধা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিক দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে আমাদের অবস্থান অনেক বেশি মজবুত হবে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির প্রভাবও অনেকটা সহনীয় হয়ে উঠবে।
‘শুল্ক’ মানেই ভয় নয়। শুল্ক আরোপ মানেই যে কোনো দেশের পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে—এমন কোনো নিয়ম নেই। অনেক সময়ই নির্দিষ্ট খাতে প্রণোদনা ও ব্যবসায়ী অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে এসব বাধা অতিক্রম করা যায়। অতীতে ভারত, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা ব্রাজিল—এমন অনেক দেশ মার্কিন শুল্কনীতির মুখে পড়েও নিজেকে দক্ষতার সঙ্গে সামলে নিয়েছে। বাংলাদেশকেও একই পথ বেছে নিতে হবে। ভয় না পেয়ে কৌশল সাজাতে হবে। অর্থনীতিকে আরও বহুমুখী, স্থিতিশীল ও উদ্ভাবনী করে গড়ে তুলতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্যনীতি যদি আরও রক্ষণশীল হয়ে ওঠে, তাহলে তা আমাদের জন্য সতর্কবার্তা বটে, কিন্তু আতঙ্কের কারণ নয়। বরং এটিকে অজুহাত না বানিয়ে, কৌশলগতভাবে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। বাঙালি জাতি চ্যালেঞ্জে ভেঙে পড়ার নয়—চ্যালেঞ্জকে জয় করার জাতি। এবারও ব্যতিক্রম হবে না—শর্ত একটাই: ভয় নয়, প্রস্তুতি।
ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলা করেছে, কোভিড-১৯ এর ধাক্কা সামলে রেকর্ড রপ্তানি অর্জন করেছে। আজকের চ্যালেঞ্জও সামাল দেওয়া সম্ভব—প্রয়োজন কৌশলগত দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক ঐক্য এবং অদম্য মানসিকতা। ট্রাম্পের শুল্কনীতি আমাদের জন্য হুমকি নয়, বরং অর্থনীতিকে আরও নমনীয়, উদ্ভাবনী ও বহুমুখী করে গড়ে তোলার আহ্বান।
বাংলাদেশ আজ একটি সম্ভাবনাময় অবস্থানে দাঁড়িয়ে। বৈশ্বিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তার মাঝেও আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি, অবকাঠামো খাতে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি, আর রপ্তানি আয় নির্বিচারে বাড়ছে। তবে এই সম্ভাবনার পথের সবচেয়ে বড় বাধা এখন আর অর্থনৈতিক নয়—তা হলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং একটি সর্বসম্মত জাতীয় উন্নয়ন কাঠামো।
আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তন মানেই অনেক সময় নীতির পরিবর্তন। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা মাঝপথে এসে থমকে যায়, বাজেট বরাদ্দে অস্থিরতা দেখা দেয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে সরে যান। এর একমাত্র কারণ—নতুন সরকার পূর্ববর্তী সরকারের নেওয়া পরিকল্পনায় আস্থা রাখতে চায় না, কিংবা বিরোধী রাজনীতি অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। এর ফলে একটা অদৃশ্য অনিশ্চয়তা কাজ করে যা অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিশ্বের উন্নত বা উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর দিকে তাকালেই দেখা যায়, তারা অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করতে পেরেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম কিংবা রুয়ান্ডার মতো দেশগুলোতে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিরোধ নেই। বাংলাদেশেও সেই ঐকমত্য গড়ে তোলার সময় এখনই।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি—রাজনৈতিক সংঘাত, হরতাল, অবরোধ বা সহিংসতা কীভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য থামিয়ে দিতে পারে। একদিনের সহিংসতায় হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, রপ্তানি পণ্য বন্দরে আটকে থাকে, শ্রমিকরা কাজে যেতে পারে না, ব্যাংকিং সেবা বাধাগ্রস্ত হয়।
এর চেয়েও বড় ক্ষতি হয় বৈদেশিক বিনিয়োগে। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা মূলধন প্রবাহিত করতে চায় স্থিতিশীল এবং পূর্বানুমেয় পরিবেশে। রাজনৈতিক সংঘাত ও অনিশ্চয়তা তাদের দূরে সরিয়ে দেয়। বাংলাদেশ যদি আগামী এক দশকে উন্নয়নশীল থেকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ অত্যাবশ্যক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এই লক্ষ্য অসম্ভব।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ বহু বড় সংকট পার করেছে—সামরিক শাসন, ঘূর্ণিঝড়, খাদ্য সংকট, বৈদেশিক চাপ। কিন্তু ২০২৫-এর বাংলাদেশ একটি নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করছে, যেখানে রাজনৈতিক সহাবস্থান ও পারস্পরিক সম্মান জরুরি। আমাদের প্রয়োজন এমন একটি 'জাতীয় উন্নয়ন রূপরেখা' (National Development Charter), যা সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী মহল ও শিক্ষাবিদদের অংশগ্রহণে গঠিত হবে।