মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ নতুন করে বিশ্ববাসীকে উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে। ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে। যদিও এ যুদ্ধ এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়নি, তবে এর অভিঘাত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। ভূরাজনৈতিক এ সংঘাতের ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। জ্বালানি নিরাপত্তা, রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি বাণিজ্য, শিপিং খাত, বিনিয়োগ ও সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর পড়ছে বহুমাত্রিক প্রভাব। এদিকে ইরানে বসবাসরত বাংলাদেশি ও বাংলাদেশে থাকা তাদের স্বজনদের যোগাযোগের জন্য তেহরান ও ঢাকায় হটলাইন চালু করেছে সরকার।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর পরোক্ষ চাপ আরও বাড়বে। এমন প্রেক্ষাপটে সাবেক কূটনীতিক, অর্থনীতিবিদ, রপ্তানিকারক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং করণীয় নিয়ে দিচ্ছেন সতর্কবার্তা ও দিকনির্দেশনা। তারা বলছেন, শুধু অর্থনীতিই নয়, সামাজিক পরিসরেও এ যুদ্ধের প্রভাব পড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে পারে। একই সঙ্গে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব ধর্মীয় আবেগ ও মতাদর্শিক বিভাজনও সৃষ্টি করতে পারে, যা অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি এম হুমায়ুন কবীর বলেন, যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। তবে এর ফলাফল যেহেতু ভয়ানক হবে, তাই সব পক্ষ যুদ্ধটা এড়াতে চাইছে। দুপক্ষের মিত্রদের আচরণ দেখেও সেটাই বোঝা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো সরাসরি জড়িয়ে না পড়লেও, পরিস্থিতির ওপর তাদের নজর রয়েছে। ফলে বড় আকারের যুদ্ধের সম্ভাবনা এখনও সীমিত থাকলেও, অর্থনৈতিক অভিঘাত বাংলাদেশসহ অনেক দেশের ওপর পড়ছেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখী চাপের মুখে পড়বে। এর প্রধান কয়েকটি দিক হলো- প্রথমত, জ্বালানি খাতে সর্বাধিক প্রভাব পড়বে। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম সম্প্রতি ৯০ ডলার ছাড়িয়েছে, যা এক মাস আগেও ছিল ৮২ ডলারের নিচে। বাংলাদেশের তেল আমদানির বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর হওয়ায় এ দামের ঊর্ধ্বগতি সরাসরি জ্বালানি ভর্তুকি, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ও পণ্যমূল্যে প্রভাব ফেলবে। বিশ্লেষক ড. মশরুর রিয়াজ বলেন, হরমুজ প্রণালিতে যদি উত্তেজনা বাড়ে, তা হলে কেবল তেলের দাম নয়, পুরো শিপিং সাপ্লাই চেইনই ব্যাহত হবে। এতে করে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা সময়মতো পণ্য সরবরাহে সমস্যায় পড়বেন।
দ্বিতীয়ত, রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৯০ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। যুদ্ধের প্রভাবে যদি ওই অঞ্চলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে, তা হলে কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে পড়বে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হলে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়বে।
তৃতীয়ত, রপ্তানি খাত ইতোমধ্যেই হুমকির মুখে পড়েছে। তৈরি পোশাক খাত, যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৪ শতাংশ, তা জ্বালানি ও কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। জ্বালানি সংকট, লজিস্টিকস বিলম্ব এবং অর্ডার কমে যাওয়া সব মিলিয়ে আমাদের ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়ছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা যদি যুদ্ধের কারণে সাপ্লাই ডিস্টার্বেন্স আশঙ্কা করেন, তা হলে ভবিষ্যতের অর্ডারও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। চতুর্থত, বিদেশি বিনিয়োগ ও বৈদেশিক মুদ্রা বাজারেও প্রভাব পড়তে পারে। যুদ্ধের জেরে বৈশ্বিক বাজারে অনিশ্চয়তা বাড়লে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বাজারে চলে যেতে পারেন। এতে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলোতে বিনিয়োগের গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে ইরানে বসবাসরত বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশে থাকা তাদের স্বজনদের যোগাযোগের জন্য তেহরান ও ঢাকায় হটলাইন চালু করেছে সরকার। গতকাল সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। যে কোনো প্রয়োজনে নিম্নোক্ত মোবাইল ফোন নম্বরগুলোতে (হোয়াটস অ্যাপসহ) সরাসরি যোগাযোগ করতে করতে বলা হয়েছে। তেহরানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের হটলাইন : +৯৮৯৯০৮৫৭৭৩৬৮, +৯৮৯১২২০৬৫৭৪৫। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঢাকার হটলাইন: +৮৮০১৭১২০১২৮৪৭।
ঝুকিঁতে বাংলাদেশ মিশন ইরানে কর্মরত বাংলাদেশিরা এখনও নিরাপদ থাকলেও ইসরায়েলি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পড়ে গেছে তেহরানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের চ্যান্সারি কমপ্লেক্স। দূতাবাস থেকে পাঠানো এক বার্তায় অন্তর্বর্তী সরকারকে এমনটা জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মিশন বিল্ডিংয়ের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইরানের একটি পরমাণু কেন্দ্রসহ কমপক্ষে দুটি সংবেদনশীল স্থাপনা রয়েছে, যাতে হামলার ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে ইসরায়েল। ফলে বাংলাদেশ মিশন, আশপাশে বসবাসরত কূটনীতিক-স্টাফ এবং তাদের পরিবারের জীবন ও সম্পদ ঝুঁকিতে। তারা এক মুহূর্তের জন্যও নিরাপদ নয়। সম্ভাব্য হামলায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আতঙ্কের মধ্য দিনাতিপাতকারী ওই সব কূটনীতিক ও স্টাফদের পরিবারকে শহরের ৩০-৪০ কিলোমিটার বাইরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পরপরই মিশনে কর্মরতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। প্রসঙ্গত, ইরানে বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত, দুজন কর্মকর্তা, পাঁচজন কর্মচারী ও তাদের পরিবারসহ প্রায় ৪০ জন রয়েছেন।