মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক বোমাওয়ালা দেশ একটিইÑ ইসরায়েল, যদিও এর শাসকরা তা কখনও স্বীকার করে না। আর এই দেশটিই প্রতিদিন আত্মরক্ষার অজুহাত তুলে গত বিশ মাস ধরে ফিলিস্তিনে প্রকাশ্যে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে ও ইউরোপসহ অন্যদের পরোক্ষ অংশগ্রহণে।
ইতোমধ্যে ইসরায়েল ৬০ হাজার গাজাবাসীকে হত্যা করেছে, যাদের অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। আর আহত করেছে দেড় লাখ মানুষ। প্রায় দেড় হাজার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং ২০০ ফিলিস্তিনি সাংবাদিক খুন হয়েছেন ইসরায়েলি হামলায়। অথচ ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সব সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের গাজায় প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে রেখেছে। ১৯৪৭ সাল থেকে সংঘটিত নির্যাতন-উচ্ছেদ-হত্যা বাদ দিয়েও, প্রতিদিন এইসব হত্যাকাণ্ড চালানোর পরও ইসরায়েল ঘোষণা করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সংবাদমাধ্যমগুলো সবসময় বলছে, এটি ইসরায়েলের আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা।
আত্মরক্ষা নামের এই সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় হলো ইরানে আকস্মিক হামলা চালিয়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া। এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের একটি দীর্ঘমেয়াদী যৌথ প্রকল্প। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে এই যুদ্ধের আশঙ্কা কমেছিল, তার আমলে ইরানের সঙ্গে একটি পারমাণবিক চুক্তি (জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন বা জেসিপিওএ) সম্পাদনের ফলে।
এই পারমাণবিক চুক্তিটি ছিল ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহুর চক্ষুশূল। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে অপদার্থ প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে পেয়ে নেতানিয়াহু তার লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যান। এবারের আগের মেয়াদে ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই ওবামার আমলে করা চুক্তিটি বাতিল করেছিলেন। এবার ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণ তাদের দুজনের জন্যই যথেচ্ছাচারের দরজা খুলে দেয়।
গাজার একটি আবাসিক এলাকায় ইসরায়েলি হামলার পর ধ্বংসস্তূপ আর ধোঁয়ার চিহ্ন—যেখানে প্রতিদিনই জীবন আর ঘরবাড়ি মিশে যাচ্ছে ধুলোকণায়। ছবি: রয়টার্স
গাজার একটি আবাসিক এলাকায় ইসরায়েলি হামলার পর ধ্বংসস্তূপ আর ধোঁয়ার চিহ্ন—যেখানে প্রতিদিনই জীবন আর ঘরবাড়ি মিশে যাচ্ছে ধুলোকণায়। ছবি: রয়টার্স
২০২৩-এর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণ নেতানিয়াহুর জন্য সৌভাগ্যের হয়ে ওঠে। চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী ইসরায়েল আবার আত্মরক্ষার কার্ডটি নিয়ে গণহত্যার খেলা শুরু করে। গোপনে ও প্রকাশ্যে বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি ও সমর্থন দেয় ইসরায়েলকে আর মুখে ফিলিস্তিনের পক্ষে দুয়েকটা কথা বলে, যা না বললেই নয়। তাদের কথায় ফিলিস্তিন ‘আক্রমণকারী’ আর ইসরায়েল ‘আক্রান্ত’, অত্রএব তাদের আত্মরক্ষার অধিকার রক্ষা আমেরিকার কর্তব্য।
দেড়বছরের বেশি চলমান গণহত্যা এবং আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক নেতানিয়াহু ও সঙ্গীদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ ও তাদেরকে আটক করার আদেশ ইসরায়েলকে বিশ্বের সাধারণ মানুষের চোখে একটি অচ্ছ্যুত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এরপর সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গসহ ১২জন মানবাধিকারকর্মীর ম্যাডেলিন নৌকায় করে মানবিক সাহায্য নিয়ে গাজা অভিমুখে যাত্রা এবং ইসরায়েলের বাহিনী কর্তৃক তাদেরকে আটক বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। আয়োজন করা হয় গ্লোবাল মার্চের। ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠি দেখতে পায় চারদিক থেকে সভ্যজগতের মানুষ ঘিরে ফেলছে তাদেরকে। গাজাকে কেন্দ্র করে নেতানিয়াহুর আত্মরক্ষার ট্রাম্পকার্ডটি ভণ্ডামি হিসেবে সর্বত্র প্রমাণিত হচ্ছে। এবার তাতে নতুন মাত্রা যোগ করতে হবে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা নেতানিয়াহুকে নতুন শক্তি দেয়, কেননা ট্রাম্পের নিজের কথায়ই, তিনি হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ইসরায়েলপন্থী প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্পের প্ররোচণায় ইসরায়েল আরও লজ্জাহীন ও লাগামহীন হয়ে ওঠে। শুরু হয় ইসরায়েলের নতুন খেলা–ইরানে হামলার দীর্ঘদিনের পুরনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নতুন ষড়যন্ত্র। যে ট্রাম্প ওবামার উদ্যোগে করা ইরানের পারমাণবিক চুক্তিটি একতরফাভাবে বাতিল করেন, এবার আবার সেই ট্রাম্পই পারমাণবিক চুক্তি করতে ইরানকে চাপ দিতে থাকেন। কয়েক দফা বৈঠক হয় যুক্তরাষ্ট্রের ও ইরানের প্রতিনিধিদের। এই চুক্তিটি সম্পাদন হলে নেতানিয়াহু তার ইরান আক্রমণের তিরিশ বছরের স্বপ্নপূরণ থেকে বঞ্চিত হবেন। এ কারণে পরবর্তী বৈঠকের আগেই ট্রাম্পের সঙ্গে যোগসাজশে ইরানের ঘুমন্ত মানুষের ওপর এই বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়।
ট্রাম্পের এই চুক্তি সম্পাদনের খেলা যে ছিল ইরানের জন্য একটি ফাঁদ, সেটি বোঝা গেল অপ্রস্তুত ইরানের ওপর ইসরায়েলের অতর্কিত হামলায়।
ট্রাম্প নাটক সাজান যে তিনি এই হামলার পক্ষে নন, ইসরায়েল তার নিজ দায়িত্বে এটি করেছে। যেন এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই। অথচ তিনি বলছেন, আমেরিকা ১২ এপ্রিল ৬০ দিনের একটি সময় বেঁধে দিয়েছিল ইরানকে, যে সময়ের মধ্যে তাদের চুক্তি করতে হবে। ইসরায়েল ১৩ জুন ৬১তম দিনে হামলা করেছে। অতএব এ হামলা হচ্ছে ট্রাম্পের কথামতন আমেরিকার সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি সম্পাদনের ব্যর্থতার ফসল।
এটা ডনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিচারিতা। একদিকে বলছেন, এই হামলার সঙ্গে আমেরিকা যুক্ত নয়, আবার অন্যদিকে ট্রাম্প ইসরায়েলের হামলাকে প্রশংসা করে বলছেন, ‘চমৎকার’। আর ইরানকে হুমকি দিচ্ছেন এখনও আমেরিকার দাবি অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদন করে প্রাণ রক্ষা করতে পারে ইরান। কিন্তু এই যে সমস্ত সভ্যতা ও আন্তর্জাতিক আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিনা উসকানিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিজ্ঞানী, সামরিক কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করা–তা সবই ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার জন্য! গাজার ও ইরানের মানুষের তো আত্মাই নেই (একমাত্র জায়োনিস্ট ও খ্রিস্টান সাদা মার্কিনিদের ছাড়া কারোরই নেই), তা আবার রক্ষার কথা উঠবে কেন?
ইসরায়েল নাকি ভয় পাচ্ছে ইরান যে কোনো সময় পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ইসরায়েলকে আক্রমণ করবে। ইরান কর্তৃক যে কোনো সময় পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলার গল্পটা নেতানিয়াহু গত তিরিশ বছর ধরেই বলে বেড়াচ্ছেন। ইরানের এই পারমাণবিক বোমা তৈরির মিথ্যা আতঙ্ক ঠিক ইরাকের বেলায় যুক্তরাষ্ট্র যা করেছিলো তা-ই। অথচ ট্রাম্প সরকারেরই গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড বলেছেন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে না।
গ্যাবার্ডের কথায় কিছু আসে যায় না, নেতানিযাহুকে ইরান আক্রমণ করতে হবে। প্রশ্ন হলো নেতানিয়াহুকে এই কর্তৃত্ব কে দিয়েছেন যে নিজেই কিনা গাজায় গণহত্যার দায়ে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক চিহ্নিত এবং নিজ দেশেও ক্ষমতাচ্যুত হওয়া মাত্রই জেলে ঢুকার অপেক্ষায়। পৃথিবীতে এখন কে কী বানাবে কিংবা বানাবে না তার নির্ধারণ করে দিবে জায়োনিস্ট রাষ্ট্র ইসরায়েল আর তার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী। কী উদ্ভট ও হাস্যকর!
যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে এই বিশ্বকর্তৃত্ব নিয়ে নেয় আফগানিস্তানে ও ইরানে হামলার সময় থেকে। জাতিসংঘকে তারা সেই যে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করেছে, এখনও তাই আছে।
তবে একটি মৌলিক পার্থক্য ঘটেছে ইসরায়েলের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রকাশে–অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রকে সিংহাসনে রেখে এবার সে-ই কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিয়েছে। ব্রাঙ্কো মার্সেটিক (ইয়েসটারডে’স ম্যান: দ্য কেস এগেইনস্ট জো বাইডেন গ্রন্থের লেখক) জ্যাকোবিন সাময়িকীতে লিখেছেন, (ট্রাম্প ইজ ডেলিভারিং অ্যান ইরান ওয়ার নো ওয়ান ওয়ান্টস, ১৩ জুন ২০২৫), “নেতানিয়াহু একবার বলেছিলেন, ‘আমেরিকা সেই জিনিস যা সহজেই নাড়ানো যায়, চাইলে সঠিক দিকেই।’ তার কথা যে রেকর্ড হচ্ছে তখন তিনি তা জানতেন না। এবার তিনি সুযোগ পেয়েছেন তা হাতেনাতে প্রমাণ করে দেখানোর।”
মার্সেটিক আরও লিখেছেন, “এটা এক নতুন পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র ও বৃহত্তর পশ্চিম সবসময় ইসরায়েলকে সাহায্য করে গেছে, কিন্তু এইভাবে তার সব নোংরা আচরণ মেনে নেয়নি। এইভাবে একে অস্ত্র, সামরিক সাহায্য, রাজনৈতিক ছত্রছায়া দিয়ে, লাগাম টেনে ধরার ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে যাতে দেশটি যাবতীয় অপরাধযজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারে। রিগ্যান থেকে বুশ পর্যন্ত বহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইতিপূর্বে মাঝে মাঝে লাগাম টেনে ধরেছেন এবং বুঝিয়েছেন কে প্রভু আর কে ভৃত্য। বিপরীতে বাইডেন ও ট্রাম্প উভয়ই মিউমিউ করে লাগাম ছেড়ে দিয়েছেন নেতানিয়াহুর হাতে, যাতে এখন ইসরায়েল চড়ে বসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে।”
অতএব এই নতুন পৃথিবীতে লেজই কুকুর নাড়াচ্ছে–বলছেন ইহুদি বংশোদ্ভূত বিশ্বখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেফ্রি স্যাকসও। তবে আসল কথা, এ আশ্চর্য ঘটনা যে কারণে ঘটছে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। লেজের মালিকসহ তার ইউরোপিয়ান সঙ্গীদের ব্যাপক স্বার্থ রয়েছে এক জায়গায়–ফিলিস্তিন দখল, গাজা থেকে ইরান পর্যন্ত গণহত্যার পর গণহত্যা ঘটিয়ে হলেও–সরাসরি নিজের হাতে না হোক, ইসরায়েলের জায়োনিস্ট শাসকদের হাতে।
সূত্র: বিডি নিউজ