যে কারণে নিজেকে অন্য অভিভাবকের সঙ্গে তুলনা করবেন না

লাইফস্টাইল ডেস্ক
  ১৪ জুন ২০২৫, ২২:৪৩

আজকাল সন্তান লালন-পালন অনেকটা দড়ির ওপর হাঁটার মতো – যেন চারদিকে অসংখ্য চোখ আপনাকেই দেখছে আর বিচার করছে। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই ‘নিখুঁত’ সব পরিবার, সাফল্যের গল্প, ঘরে তৈরি খাবার, পরিপাটি গুছানো ঘর আর প্রতিযোগিতায় জয়ী বাচ্চাদের ছবি। এসব দেখে মনে হতে পারে – অন্য সবাই পারফেক্ট, আমিই শুধু পিছিয়ে থাকলাম।
কিন্তু আসলে এগুলো শুধুই অন্যের চোখের জন্য। বাস্তব জীবন কখনো এতো পরিপাটি হয়না। তবে তুলনার এই বীজ থেকে জন্ম নিতে পারে অপরাধবোধ, আত্মসন্দেহ আর মানসিক ক্লান্তি। একজন বাবা বা মায়ের জন্য জীবন এমনিতেই অনেক কঠিন। সেখানে এমন নেতিবাচক অনুভূতি আপনাকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। এছাড়া বেশ কিছু কারণে আপনার নিজেকে কখেই অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে তুলনা করা উচিত না। চলুন জেনে নেওয়া যাক কারণগুলো-

১. যা দেখানো হয়, তা পুরো সত্যি নয়
অন্যরা সব যেন সহজেই সামলে নিচ্ছে! সন্তানের পড়াশোনা, শৃঙ্খলা, এমনকি রান্নাবান্নাও। কিন্তু গল্পের আসরে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসলে সবাই শুধু ভালো মুহূর্তগুলোই শেয়ার করে। বাচ্চার জেদ, পড়া না করা, অসুস্থতায় রাত জেগে যত্ন করা – এসব কেউ পোস্ট করে না। সবাই নিজের জীবনকে একটু ‘এডিট’ করেই সামনে আনে।
এই অদেখা অংশগুলোই আমাদের ভাবায় যে, ‘আমিই একা পিছিয়ে থাকলাম।’ বাস্তবে কেউই সবকিছু পারফেক্টভাবে সামলায় না। সবার জীবনেই কিছু যুদ্ধ আছে, চ্যালেঞ্জ আছে। তাই অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা
২. প্রতিটি বাচ্চাই আলাদা, তাদের ‘ম্যানুয়াল’ ও আলাদা
একটি বাচ্চা চার বছরে পড়তে শেখা মানে সব বাচ্চারই তা পারা উচিত, বিষয়টি মোটেও এমন নয়। প্রত্যেকটি শিশুর বিকাশের নিজস্ব গতি আছে। আবার ব্যক্তিত্বেরও পার্থক্য আছে। তাই একটি শিশুর ক্ষেত্রে শাসন করা যেমন ফল আনবে, আরেকটি শিশুর ক্ষেত্রে তা আনবে না। অর্থাৎ তাদের শেখানোর ম্যানুয়াল বা নির্দেশিকা ভিন্ন ভিন্ন।
প্রতিটি শিশুর বিকাশের গতি, আগ্রহ আর দক্ষতা ভিন্ন। একজনের সঙ্গে অন্যজনের তুলনা শুধু অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করে। কেউ আগে কথা বলে, কেউ দৌড়ায়; কেউ গণিতে কাঁচা, কেউ আঁকায় সেরা। সন্তান লালন-পালন মানে চেকলিস্ট টিক দেওয়া নয় – বরং তার স্বতন্ত্র গতিকে বুঝে এগোনো। তাই অন্যের বাচ্চার সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে নিজেকে বিফল মনে করবেন না। আপনার শিশুর প্রয়োজন সবচেয়ে ভালো আপনিই বুঝবেন।
৩. তুলনা দোষ তৈরি করে, উন্নতি নয়
কেউ ভালো করছে দেখে আপনি উৎসাহিত হতেই পারেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময়, তুলনা শুধু মনে অহেতুক দোষ আর সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়। নিজের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি বিরতি নিয়ে প্রশ্ন জাগে। এই দোষবোধ আনন্দকে ঢেকে ফেলে, সম্পর্ককে পরিণত করে প্রতিযোগিতায়। কিন্তু উন্নতি আসে শেখা, বোঝা আর ভালোবাসা থেকে, তুলনা থেকে নয়।
৪. অন্যের আড়ালে নিজের ভালো গুণগুলো ঢাকা পড়ে
আপনার পরিচিত কোনো মা হয়তো তার শিশুকে টিফিনে হরেক রকম মজার খাবার বানিয়ে দিচ্ছে, তখন আপনার মনে হতে পারে উনি আপনার থেখে ভালো মা। কিন্তু প্রত্যেক বাবা-মায়েরই নিজস্ব গুণ আছে – কেউ বাচ্চার সঙ্গে খেলাধুলায় পারদর্শী, কেউ আবার চমৎকার পড়াতে পারেন, কেউ হয়তো সৃজনশীল বিষয়গুলো শিশুর আগ্রহ তৈরি করাচ্ছেন। তাই অন্যের সঙ্গে তুলনা না করে ভাবুন- আপনার ছোট ছোট গুণও মূল্যবান।
ধৈর্য্য ধরে কথা শোনা, কান্না থামানো, বা শুধু পাশে থাকা – এগুলো হয়তো চোখে পড়ে না, কিন্তু বাচ্চার জীবনে এগুলোর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
৫. মানসিক স্বাস্থ্য পিছিয়ে পড়ে
‘সবাই আমার থেকে এগিয়ে গেলে।’ এই অদৃশ্য প্রতিযোগিতা আপনাকে সামনে নিয়ে যাবেনা। বরং আপনার ও আপনার শিশুর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করবে। এটি আপনার সন্তানের সঙ্গে আপনার সম্পর্কও দুর্বল করে দিতে পারে। সেই সঙ্গে আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেবে। তাই নিজেকে সুস্থ রাখা সবসময় ‘পারফেক্ট’ হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। শুধু সন্তানের জন্য নয়, আপনার নিজের জন্যেও।
৬. অভিভাবকত্ব কোনো ফর্মুলা নয়, এটি একটি সম্পর্ক
অন্য অভিভারকের জন্য যে কৌশল কাজ করছে, তা আপনার ক্ষেত্রেও করবে – এমনটি ভাববেন না।

প্যারেন্টিং শুধু পদ্ধতি নয়, এটি পরস্পর বোঝাপড়া আর সম্পর্কের একটি বিষয়। এক পরিবারে যা কাজ করে, অন্য পরিবারে তা ব্যর্থও হতে পারে। সংস্কৃতি, শিশুর স্বভাব, পারিবারিক পরিবেশ, এসবই এখানে প্রভাব ফেলে। অন্ধভাবে অন্যের পদ্ধতি অনুসরণ করলে উল্টো প্রভাবও পড়তে পারে।
তাই নিজের ও সন্তানের ভালোর জন্য আপনার কাছে যা সঠিক, সেটিকে গুরুত্ব দিন। শিশুর নিরাপত্তা, শিক্ষা ও পুষ্টি ছাড়া অন্য বিষয়ে বেশি চাপ নিয়ে সন্তানের শৈশবকে প্রতিযোগিতায় পরিণত করবেন না।

সূত্র: টাইমস্ অব ইন্ডিয়া