যুক্তরাজ্যের গুপ্তচর সংস্থা সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা এমআই সিক্সের নতুন প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন ব্লেইস মেট্রেভেলি। এদিকে দায়িত্বপ্রাপ্তির পর তার দাদার পরিচয় নিয়ে ব্রিটেনজুড়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
৪৭ বছর বয়সী ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি এমআই সিক্সের ১১৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। বছরের শেষদিকে বর্তমান প্রধান রিচার্ড মুরের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা তার।
এর মধ্যেই জার্মান এক আর্কাইভে থাকা একগুচ্ছ নথির বরাত দিয়ে ডেইলি মেইলের এক খবরে বলা হয়েছে, মেট্রেওয়েলির দাদা কনস্টান্টিন দোবরোভলস্কি ছিলেন নাৎসিদের সহযোগী; তিনি ‘ইহুদি হত্যায় অংশ নেওয়ায়’ গর্বিতও ছিলেন।
দোবরোভলস্কি ছিলেন ইউক্রেইনের বাসিন্দা; পরে তিনি সোভিয়েত রেড আর্মির পক্ষত্যাগ করে চেরনিহিভ অঞ্চলে অ্যাডলফ হিটলারের প্রধান গুপ্তচরে পরিণত হন, পরিচিতি পান ‘দ্য বুচার’ বা ‘কসাই’ নামে, ডেইলি মেইলের খবরে এমনটাই বলা হয়েছে বলে জানিয়েছে টেলিগ্রাফ।
মেট্রেওয়েলির সঙ্গে কখনোই তার দাদার দেখা হয়নি। ১৯৪৩ সালে রেড আর্মির হাতে চেরনিহিভ অঞ্চল মুক্ত হওয়ার সময় পরিবারের বাকি সদস্যরা পালিয়ে গেলেও দোবরোভলস্কি নাৎসিদের দখলে থাকা ইউক্রেইনেই থেকে যান।
জার্মান একটি আর্কাইভ থেকে বের হওয়া নথি বলছে, দোবরোভলস্কি নাৎসিদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘এজেন্ট নাম্বার ৩০’ হিসেবে।
এক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল ৫০ হাজার রুবল, এখনকার হিসাবে যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। সেভিয়েতরা তাকে ‘ইউক্রেইনের লোকজনের সবচেয়ে বড় শত্রু’ বলেও অ্যাখ্যা দিয়েছিল।
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন বলছে, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় দোবরোভলস্কির পরিবারের অনেক সদস্য মারা পড়েছিল, তাদের সম্পদও জব্দ হয়েছিল। সেসবেরই প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন তিনি।
এক নথিতে নাৎসি ঊর্ধ্বতনদের কাছে দোবরোভলস্কির হাতে লেখা একটি চিঠিও পাওয়া গেছে, যেখানে এ গুপ্তচর স্বাক্ষর করেছিলেন ‘হেইল হিটলার’ লিখে।
আরেক চিঠিতে তিনি শতাধিক ইউক্রেইনীয় সৈন্য এবং ‘ইহুদি নিধনযজ্ঞে ব্যক্তিগতভাবে’ অংশ নেওয়ায় গর্বও করেছেন।
ধারণা করা হচ্ছে, তার পরিবার যখন পালিয়ে জার্মানি চলে যাচ্ছে, তখনও তিনি সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে ইউক্রেইনে থেকে গিয়েছিলেন। পরে তার কী হয়েছে, তা অজানা।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়ন বিষয়ক কার্যালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, “ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি তার দাদাকে কখনো দেখেননি। তার পারিবারিক ইতিহাস নানা বিভাজন ও সংঘাতে ঘেরা, পূর্ব ইউরোপীয় শেকড়ের অনেকের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা এরকম, যার পুরোটা জানাও যায় না।”
নতুন এমআই৬ প্রধান হিসেবে ব্লেইজ মেট্রেওয়েলির এই জটিল পারিবারিক ইতিহাসই তাকে সংঘাত প্রতিরোধ ও আধুনিক বৈরী রাষ্ট্রগুলোর হুমকি থেকে ব্রিটিশ জনগণকে রক্ষায় প্রতিশ্রুতিশীল করে তুলেছে, বলেছেন তিনি।
মেট্রেওয়েলির বাবা যুক্তরাজ্যে কখন এসেছেন, বা কি করতেন সে সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। যদিও ১৯৬৬ সালে লন্ডন গেজেটে তার নাম এসেছে এভাবে- দোবরোভলস্কি, কনস্টানটিন (কনস্টানটিন মেট্রেওয়েলি হিসেবে পরিচিত), জাতীয়তা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে।
এই তথ্যটি প্রথম সামনে আনেন রুশ এক প্রচারক, যার দাবি, “যুদ্ধপরবর্তী ব্রিটেনে যে ইউক্রেইনীয়রা অভিবাসী হয়েছে, তাদের বড় অংশই ছিল নাৎসিদের এসএস গ্যালিসিয়া ডিভিশনের, যারা ইতালিতে ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।”
এরপরই মেট্রেওয়েলির বংশ পরিচয়ের খোঁজ শুরু হয়ে যায়।
সেই পরিচয় পরে বের করে আনেন জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসির ইলিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির আধুনিক ইতিহাসের অধ্যাপক বেকা কোবাখিদজে। তিনি বলেন, “মেট্রেওয়েলির বংশ পরিচয় ‘সামনের বহু বছর ধরে রুশ প্রচারকদের আলোচনার প্রিয় বিষয় হয়ে উঠবে।”
“সন্তানদের তো অবশ্যই তার বাবার কিংবা দাদা-নানার পাপের জন্য দায়ী করা যায় না। কিন্তু আমি ধাঁধাঁয় আছি, কেন যুক্তরাজ্য ইচ্ছা করেই এমন ‘অস্ত্র’ রাশিয়ার হাতে তুলে দিচ্ছে,” বলেছেন তিনি।
বিদেশে বড় হওয়া মেট্রেওয়েলি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে পড়েছেন, সেখানে তিনি ১৯৯৭ সালের এক নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলে ছিলেন।
তিনি ১৯৯৯ সালে এমআই সিক্সে যোগ দেন; দুই দশক ধরে তিনি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে গুপ্তচর সংস্থাটির নানান দায়িত্ব সামলেছেন।
মেট্রেওয়েলি বর্তমানে এমআই সিক্সের প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন বিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। ‘কিউ’ নামে পরিচিত এই পদের কাজ হচ্ছে- গোপন এজেন্টদের পরিচয় রক্ষা করা এবং শত্রুদের মোকাবিলায় চীনের বায়োমেট্রিক নজরদারির মত নতুন উপায় বের করা।
প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর তার সঙ্কেত বা কোড হবে ‘সি’। এমআই সিক্স প্রধানই কেবল প্রকাশ্যে থাকেন।