কুসংস্কারমুক্ত সমাজ বিনির্মাণকারী ‘রামঠাকুর’ যেন আলোকবর্তিকা

ফিচার ডেস্ক
  ১০ জুলাই ২০২৫, ২৩:১৫

কারো কাছে তিনি শ্রীশ্রীকৈবল্যনাথ, কারো কাছে তিনি শ্রীশ্রীসত্যনারায়ণ, আবার কারো কাছে তিনি শ্রীশ্রীরামঠাকুর। আর অন্য ধর্মের মানুষের কাছে তিনি রামসাধু। অর্থাৎ সাধারণ ভক্তদের দুঃখ দুর্দশা দূর করার জন্য শ্রীশ্রীসত্যনারায়ণ, উচ্চস্তরের ভক্তদের মোক্ষলাভের জন্য শ্রীশ্রীকৈবল্যনাথ আর শ্রীশ্রীরামচন্দ্রদেবের ভক্তদের কাছে শ্রীশ্রীরামঠাকুর এক অপূর্ব সম্পদ। তিনি এক-এক সময় ভিন্ন স্থানে তিন ধরনের শ্রীপটে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শ্রীশ্রীরামঠাকুর-শ্রীশ্রীকৈবল্যনাথ-শ্রীশ্রীসত্যনারায়ণ তিনে এক-একে তিন।
ভক্তরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন শ্রীশ্রীরামঠাকুর যুগাবতার ও কলিযুগের ত্রাতা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যিনি সবাইকে এনেছেন সত্য, শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির মিছিলে। বৈষম্যহীন ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ বিনির্মাণকারী তিনি এই যুগের ‘আলোকবর্তিকা’। যুগ যুগ ধরে আলোকিত করেছেন লাখ লাখ মানব জীবন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৮৬০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গামানিক এলাকায় মামার বাড়ি জন্মগ্রহণ করেন শ্রীশ্রী রামঠাকুর। তার বাবা শ্রী রাধামাধব চক্রবর্তী ছিলেন একজন সাধক। আর মা শ্রীমতি কমলাদেবী চক্রবর্তী ছিলেন সেবাপরায়ণা নারী। চার ভাইদের মধ্যে রামঠাকুর ছিলেন সেজো। শ্রীশ্রীরামঠাকুরের আদিনিবাস ছিল বর্তমান নড়িয়া উপজেলার জপসা ইউনিয়নের কৃর্তিনাশা নদীর তীরে। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে শ্রী রাধামাধব চক্রবর্তী তার শ্বশুরবাড়ি ডিঙ্গামানিক এলাকায় বসবাস শুরু করেন।
ছোটবেলা থেকেই শ্রীশ্রীরামঠাকুর ছিলেন প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী। শৈশবে গ্রামের পাঠশালায় বাংলা শেখার মাধ্যমে তার শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয়। তবে লৌকিক বিদ্যায় তার বিশেষ প্রয়োজন না থাকায় তার শিক্ষাজীবন বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। ছোট বয়সেই তিনি রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ চর্চায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। তিনি সবসময় একাকি থাকতে পছন্দ করতেন এবং কালীপূজা, হরিপূজা ছিল তার বাল্যখেলা। ছোটবেলা হতেই ঠাকুরের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন বাবার গুরুদেব শ্রীঁমৃত্যুঞ্জয় ন্যায়পঞ্চানন।
মাত্র আট বছর বয়সে শ্রীশ্রীরামঠাকুর তার পিতাকে হারান। পিতার মৃত্যুর কয়েক দিন পর মারা যায় বাবার গুরুদেব শ্রীঁমৃত্যুঞ্জয় ন্যায়পঞ্চাননও। কোনো এক অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে স্বপ্নে দেখা দিয়ে গুরুদেব তাকে সিদ্ধ মন্ত্র দেন। এরপর থেকেই তার জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। ১৮৭২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে মোক্ষলাভের আশায় তিনি সবার অগোচরে দেশান্তরী হন। এরপর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তিনি পৌঁছান ভারতের আসাম রাজ্যের শ্রীশ্রী কামাক্ষ্যাদেবীর মন্দিরে। সেখানে তার স্বপ্নে আসা সিদ্ধ মন্ত্র দেওয়া সেই জটাধারী, দীর্ঘাঙ্গী এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষকে দেখতে পান। তাকেই তিনি গুরু হিসেবে বরন করে নেন। শ্রীশ্রীরামঠাকুরের জীবন কথা বইয়ে গুরুদেবকে ‘অনঙ্গদেব’ নামে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
এরপর তিনি তার গুরুদেবের সঙ্গে হিমালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এরপর দীর্ঘ এক যুগ হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে তপস্যা শেষে গুরুর নির্দেশে মায়ের সেবার জন্য নিজ বাড়ি ডিঙ্গামানিক এলাকায় ফিরে আসেন। তবে তখন ঠাকুরের পরিবারের আর্থিক অবস্থা নাজুক ছিল। বিষয়টি উপলব্ধি করে তিনি নোয়াখালী শহরের অক্ষয় জর্জের বাসায় পাচকের কাজ নেন। সেখানে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ হাতে নানাবিধ মুখরোচক ব্যঞ্জন, মিষ্টান্ন ইত্যাদি রান্না করে সবাইকে খাওয়াতেন।
পরবর্তীতে তিনি তার গুরুদেবের আদেশে নোয়াখালীতেই ভাত ত্যাগ করেছিলেন। একপর্যায়ে জর্জ বুঝতে পারেন, তার বাড়ির পাচক কোনো সাধারণ মানুষ নয়, এক মহাপুরুষ। বিষয়টি জানার পর তিনি তাকে আর পাচকের কাজ করতে না দিয়ে ফেনী শহরে এক সরকারি কাজে নিযুক্ত করে দেন। ঠাকুর যা উপার্জন করতেন সেই অর্থ মা, ভাইয়ের জন্য বাড়িতে পাঠাতেন ও বাকি কিছু টাকা পোস্ট অফিসে জমা রাখতেন।
শ্রীশ্রীরামঠাকুর উচ্চ বংশের ব্রাহ্মণ পরিবারের হয়েও ফেনী শহরে থাকাকালীন নানা জাতের মানুষকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতেন। এক কথায় তখনকার বর্ণপ্রথাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। শ্রীশ্রী রামঠাকুর তার জীবনের অর্ধেক সময় লোকচক্ষুর আড়ালে গভীর যোগ সাধনায় মগ্ন ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, ভারতের কোলকাতা, হুগলি, শান্তিপুর, উত্তরপাড়াসহ গাজিয়াবাদে তপস্যায় নিযুক্ত ছিলেন।
১৯০৩ সালে তার মা মারা যান, তখন তিনি কলকাতার কালিঘাটে ছিলেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে এসে আসেন। এরপর থেকেই তিনি মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে নাম বিতরণ করেন। হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র। তার শেষ জীবন কেটেছে নোয়াখালী জেলার চৌমুহনীতে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের পহেলা মে অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে ৯০ বছর বয়সে তিনি মহাপ্রস্থান করেন। চৌমুহনীতেই তাকে সমাহিত করা হয়। শ্রীশ্রীরামঠাকুরের জীবদ্দশাতেই চট্টগ্রাম পাহাড়তলীতে, নিজ জন্মভূমি ডিঙ্গামাণিক এবং কলিকাতার যাদবপুরে তিনটি আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ বিদেশে তার রয়েছে লক্ষাধিক ভক্ত ও অনুরাগী।
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের ডিঙ্গামানিক এলাকায় ২২ একর জায়গায় তার জন্মভূমিতে রয়েছে শ্রীশ্রীসত্যনারায়ণের মন্দির। ঠাকুরের নির্দেশে এই জায়গাটিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শ্রীশ্রীসত্যনারায়ণের সেবামন্দিরের মূল মন্দির। এছাড়া পরবর্তীতে নাটমন্দির, মহারাজ ভবন, ঠাকুরের জন্মঘর, দূর্গা মন্ডপ, কালী মাতার মন্দির, কমলামাধব স্মৃতি মন্দির, মোহন্তদের স্মৃতি মন্দির।
এছাড়া অনুষ্ঠানে আগত ভক্তদের জন্য দুটি চারতলা ভবন বিশিষ্ট যাত্রীনিবাসসহ ৮ টি ভবন রয়েছে। আরও রয়েছে ১০ টি পুকুর। এদের মধ্যে তিনটি রয়েছে প্রধান পুকুর। মূলমন্দিরের পশ্চিম পাশে রয়েছে ‘অমৃত কুন্ড’, বাড়ির মধ্যে ‘মায়া কুন্ড’ ও বহির্বাটির পুকুরটিকে বলা হয় ‘শ্রীকুন্ড’। শ্রীশ্রীরামঠাকুর বলেছেন, অমৃত কুন্ডে স্নান করলে শরীর নিরোগ ও পবিত্রতা লাভ হয়, শ্রীকুন্ডে স্নান করল্ব অপার শান্তি অনুভূত হয় এবং মায়াকুন্ডটি মেয়েরা শুচি, অশুচিতে সারাবছর ব্যবহার করেন।
ঠাকুরের নির্দেশে ডিঙ্গামানিক এলাকায় ১৩৫৫ বাংলা সনের ২৯ মাঘ মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। মন্দির প্রতিষ্ঠার এই সময়ে বাংলা সনের ২৭, ২৮ ও ২৯ মাঘ তিনদিন ব্যাপী নামযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এসময় শ্রীশ্রীঠাকুর বাড়িতে দেশি বিদেশি লাখো ভক্তের সমাগম ঘটে। এছাড়াও শুক্লা ত্রোয়দশী তিথিতে মহন্ত মহারাজদের স্মরণে আরেকটি উৎসব পালন করা হয়।
শ্রীশ্রীরামঠাকুরের মামাতো ভাইয়ের মেয়ে ঊমা রানী চক্রবর্তী বলেন, আমার বাবার পিসতুতো ভাই রাম ঠাকুর। তিনি সম্পর্কে আমার জেঠু। মা বাবার কাছে শুনেছি ঠাকুর ১২ বছর বয়স থেকেই দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন ধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি সব ধর্মের মানুষকে এক চোখে দেখতেন। তার অনেক ভক্ত ও অনুসারী আছে।
বরিশালের ঝালকাঠি থেকে স্বামী ভানু দেব পালের সঙ্গে মন্দির দর্শনে এসেছেন মালতী রানী পাল। তিনি বলেন, আমরা যখনি সময় পাই, তখনি এই মন্দিরে দর্শনে আসি। শ্রীশ্রীরামঠাকুর ঈশ্বরের একজন মহাপুরুষ। তার কাছে আমরা আমাদের মনোষ্কামনা রাখলে তিনি তা পুরণ করে দেন।
ডিঙ্গামানিক এলাকাকে ধর্মীয় তীর্থস্থান মনে করেন শ্রীশ্রীরামঠাকুরের ভক্ত ও অনুসারীরা। এখানে আসলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায় বলেন জানান তারা। এমনি একজন ব্যক্তি চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ এলাকার বিশ্বজিৎ বণিক। একটু শান্তি লাভের আশায় তিনি এবং তার বাল্যবন্ধু অজিত বনিক এসেছেন ডিঙ্গামানিক এলাকায়। তিনি জানান, ডিঙ্গামানিক আমাদের ধর্মীয় তীর্থস্থান। সময় পেলেই আসার চেষ্টা করি। গ্রাম্য পরিবেশে মন্দিরটি খুব সুন্দর। জায়গাটিতে আসলেই মনে এক ধরনের মানসিক শান্তি কাজ করে। ঠাকুর দর্শন শেষে মন্দিরের প্রাঙ্গণে হাঁটাহাঁটি করছি। আরও কিছুক্ষণ কাটাবো। আশা রাখছি সময় পেলে আবার আসবো।
শ্রীশ্রীরামঠাকুরের মতানুসারী কৃষ্ণা রানী কুন্ডু নামের এক স্কুল শিক্ষিকা বলেন, ‘ঠাকুরের প্রতি আমার মনপ্রাণ সব সময় সমর্পিত। আমি যখন যেভাবে ঠাকুরকে স্মরণ করি, ঠাকুর সেভাবে আমাকে পথ দেখায়। আমার জীবনের সব কিছুই ঠাকুরকে ঘিরে। আমার অন্তরাত্মা ঠাকুরের প্রতি, ঠাকুর ছাড়া আমার আর কিছুই নেই।’
শ্রীশ্রীসত্যনারায়ণ সেবা মন্দিরের উৎসব কমিটির সভাপতি ডা. গোবিন্দ চন্দ্র পাল বলেন, ‘আমরা ঠাকুরকে ভগবান স্বরূপ ও গুরুরুপে শ্রদ্ধা এবং ভক্তি করে থাকি। বাংলাদেশসহ দেশের বাহিরেও তার অসংখ্য মন্দির রয়েছে। ঠাকুরের নির্দেশে তার জন্মস্থান ডিঙ্গামানিক এলাকায় ২২ একর জায়গা নিয়ে এই মন্দিরটি গড়ে উঠেছে। আমাদের এখানে দুটি উৎসব হয়ে থাকে। একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা উৎসব ও আরেকটি মহন্ত উৎসব। এই উৎসবকে ঘিরে দেশ বিদেশের লাখো ভক্তের সমাগম ঘটে। আগত ভক্তদের জন্য থাকা ও প্রসাদ গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়।’