ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। শুক্রবার (১৩ জুন) থেকে শুরু হওয়া এই সংঘাতে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইসরায়েলের একতরফা আগ্রাসনের জবাবে ইরান একযোগে শতশত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।
ইসরায়েলে ছোড়া শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের অনেকগুলোই ইসরায়েল প্রতিহত করতে পারলেও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে মধ্য তেল আবিবসহ বিভিন্ন এলাকায় আঘাত হানে। এতে প্রাণহানি ও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে।
ইরানের ঠিক কতটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তা নির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও এটি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহৎ ও আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার বলে ধারণা করা হয়।
এমন ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে কাজ করে ও ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘাতে এগুলো কীভাবেই-বা ব্যবহৃত হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখেছে আল–জাজিরা:
কীভাবে কাজ করে
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এমন দূরপাল্লার অস্ত্র, যা প্রচলিত বা পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে পারে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে বক্র বা ধনুকের মতো পথে চলে এটি।
শক্তিশালী রকেট ইঞ্জিন দিয়ে উৎক্ষেপণের পর এ ক্ষেপণাস্ত্র বায়ুমণ্ডলের উঁচু স্তর, এমনকি মহাকাশে প্রবেশ করে। ছুটে চলে অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতিতে। ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার পর এ ক্ষেপণাস্ত্র পূর্বনির্ধারিত পথ ধরে আবার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।
দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে ১০ হাজার কিমি
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কয়েক শ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।
পাল্লা অনুযায়ী এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়—
যুদ্ধক্ষেত্র পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল (বিআরবিএম): ২০০ কিলোমিটারের কম (১২৪ মাইল)।
স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল (এসআরবিএম): ১ হাজার কিলোমিটারের কম (৬২১ মাইল)।
মধ্যমপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল (এমআরবিএম/আইআরবিএম): ১ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার (৬২১ থেকে ২ হাজার ১৭৫ মাইল)।
দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল (এলআরবিএম): ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার (২ হাজার ১৭৫ থেকে ৩ হাজার ৪১৮ মাইল)।
আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম): ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটারের বেশি (৩ হাজার ৪১৮ মাইল)।
এ ক্ষেপণাস্ত্র কত গতিতে চলে
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন। এটি কয়েক মিনিটের মধ্যেই কয়েক হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করতে পারে। এ গতি মাখ এককে মাপা হয়, যেখানে ১ ইউনিট শব্দের গতির সমান (প্রায় ১ হাজার ২২৫ কিমি/ঘণ্টা বা ৭৬১ মাইল/ঘণ্টা)।
স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সাধারণত সুপারসনিক গতিতে চলে (মাখ ১-এর বেশি)। আর দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হাইপারসনিক গতিতে চলে (মাখ ৫ বা এর বেশি, অর্থাৎ ৬ হাজার ১২৫ কিমি/ঘণ্টা বা ৩ হাজার ৮০৬ মাইল/ঘণ্টার বেশি)।
ইরান থেকে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র পৌঁছাতে কত সময় নেয়
ইরান ও ইসরায়েলের দূরত্ব ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার (৮০০-৯৩০ মাইল)। ইরান থেকে মাখ ৫ গতির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হলে তা ইসরায়েলে পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ১২ মিনিট। তবে প্রকৃত সময় নির্ভর করে ক্ষেপণাস্ত্রের ধরন ও উৎক্ষেপণস্থলের ওপর।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কেন আটকানো কঠিন
এই ক্ষেপণাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, এগুলো দূরপাল্লার ও দ্রুতগতির। এসব ক্ষেপণাস্ত্র আটকানোও খুব কঠিন।
দীর্ঘ উচ্চতা থেকে নেমে আসা ও দ্রুতগতির উড়ালপথের কারণে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তার প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় কম পায়। উৎক্ষেপণের পর বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশ করার সময় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বেশি দ্রুতগতিতে নেমে আসে, ফলে বাধা দেওয়া অধিকতর কঠিন হয়ে পড়ে।
কিছু ক্ষেপণাস্ত্র আবার ভুয়া লক্ষ্যবস্তু বা পাল্টা প্রতিরোধব্যবস্থা সক্রিয় করে, যা রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করে। এটিও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করাকে কঠিন করে তোলে।
ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য
ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেছে। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র যেখানে অনেক উঁচুতে উঠে পরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে; সেখানে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র চালকবিহীন প্লেনের মতো নিচু দিয়ে উড়ে যায়।
ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ধীরগতির হলেও নিচু দিয়ে ওড়ায় রাডারের এগুলো শনাক্ত করতে কষ্ট হয়। এ ছাড়া এগুলো মাঝপথে দিক পরিবর্তন করতে পারে, ফলে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও বিভ্রান্ত হয়।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইরান থেকে ইসরায়েলে যেতে সময় নেয় প্রায় ১২ মিনিট। ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা। ড্রোনের লাগতে পারে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত।
গত তিন দশকে ইরান ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের এক বিশাল ভান্ডার গড়ে তুলেছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি সহায়তায় ইসরায়েলও দূরপাল্লার ও পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে।
ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেমন
ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে পরিচিত অংশ হলো আয়রন ডোম। এতে এমন একটি রাডার রয়েছে, যা ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ও দিক শনাক্ত করতে পারে।
মধ্য ও দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ব্যবহৃত হয়: ডেভিড’স স্লিং—৪০ থেকে ৩০০ কিমি (২৫ থেকে ১৮৬ মাইল) পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে সক্ষম। অ্যারো সিস্টেম-২ হাজার ৪০০ কিমি (১ হাজার ৪৯১ মাইল) পর্যন্ত পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করতে সক্ষম।