জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে দুদিন দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দরে আমদানি-রফতানির শুল্ককর আদায় কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এতে বিভিন্ন বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা গাড়ির জট তৈরি হয়। স্থবির হয়ে পড়ে স্থলবন্দরগুলোর সামগ্রিক কার্যক্রম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। তাদের কর্মসূচির কারণে অন্তত হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সরকার।
পাশাপাশি আমদানি-রফতানি কার্যক্রমেও মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর এবং বেসরকারি ডিপোগুলোতে জমেছে কনটেইনারের জট। এই জট কাটতে এক সপ্তাহ লাগবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা এ কর্মসূচির কারণে শনিবার থেকে ঢাকার এনবিআর ভবন থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর, ঢাকা কাস্টম হাউসসহ দেশের সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে স্থলবন্দরগুলোতে দুই দেশের যাত্রী পারাপারের কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল। এরই মধ্যে রবিবার রাতে কর্মসূচি প্রত্যাহার সোমবার কাজে ফিরেছেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে কার্যক্রম সচল হলেও পুরোপুরি কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসেনি। কমপ্লিট শাটডাউন ও টানা কর্মবিরতির ধাক্কা সামলাতে চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টমের সময় লাগতে পারে এক সাপ্তাহ, এমনটাই জানালেন কর্মকর্তারা।
সোমবার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে গিয়ে দেখা গেছে, আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত শুল্কায়নের কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে শুল্ককর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগ দিয়েছেন। তাদের উপস্থিতিতে সরব হয়ে উঠেছে বন্দর। ব্যবসায়ীরা কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন। সকাল থেকে পণ্যের শুল্কায়ন শুরু হয়ে চলে বিকাল পর্যন্ত।
হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত সরকার
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার সাইদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোমবার থেকে কাস্টমের সব ধরনের কাজ শুরু হয়েছে। এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগ দিয়েছেন। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত দাফতরিক কাজ করেছেন সবাই। কেউ কেউ আন্দোলনের নানা দিক নিয়েও আলোচনা করেছেন।’
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ১৩ মে আদায় হয়েছে ২৮৭ দশমিক সাত কোটি টাকা, ১৪ মে ৩২৭ দশমিক ছয় কোটি, ১৫ মে ৩৭৪ দশমিক ৪৬ কোটি, ১৬ মে ৫৪ কোটি, ১৭ মে ২০৫ দশমিক ৯২ কোটি, ১৮ মে ৩৪১ দশমিক ২৫ কোটি, ১৯ মে ২৭৫ দশমিক ৪৭ কোটি, ২০ মে ২৬০ দশমিক ৬৮ কোটি এবং ২১ মে আদায় হয়েছে ৩১৬ দশমিক ৯৭ কোটি টাকার রাজস্ব।
দিনে কত টাকা রাজস্ব আদায় হয় জানতে চাইলে উপকমিশনার সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রাম কাস্টমে দিনে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। এই হিসাবে শাটডাউনের কারণে দুদিনে ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়নি। আউটারে কিছু জাহাজ ভেড়ার অপেক্ষায় আছে। আগে যেখানে আমরা রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করতাম সেখানে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কাজ করলে শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
শাটডাউন ও কর্মবিরতির কারণে বার্ষিক রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আশা করছি ঘাটতি হবে না। গত বছরের চেয়ে চলতি বছর রাজস্ব আদায় ১০ শতাংশ বেশি হতে পারে।’
কাস্টমের এই কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনিবার ও রবিবার পুরোপুরি বন্ধ ছিল চট্টগ্রাম কাস্টমের কার্যক্রম। এতে রাজস্ব আসেনি ৬০০ কোটি টাকা। এর বাইরে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা মাসব্যাপী কর্মসূচিতে কখনও দুই ঘণ্টা, কখনও তিন-চার ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাতে আরও ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কমেছে। সব মিলিয়ে এই আন্দোলনে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় থেকে পিছিয়ে গেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। এতে বড় ক্ষতি হয়েছে সরকারের।
জরিমানার মুখে জাহাজ
দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯৩ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়ে থাকে। স্বাভাবিক সময়ে বন্দর থেকে দিনে চার থেকে সাড়ে চার হাজার কনটেইনার খালাস হয়ে থাকে। শুল্ক বিভাগের ছাড়পত্র না পাওয়ায় রবিবার একটি আন্তর্জাতিক শিপিং প্রতিষ্ঠানের রফতানি পণ্যবোঝাই তিনটি ও কাঁচামাল নিয়ে আসা দুটি জাহাজ পণ্য খালাস করে বন্দর ছাড়তে পারেনি। বন্দরে বর্তমানে ১২৯টি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে কনটেইনারবাহী ৩১টির মধ্যে ২১টি শাটডাউনের কারণে জেটিতে ভেড়ার অপেক্ষায় বহির্নোঙরে দাঁড়িয়ে ছিল। বহির্নোঙরে অবস্থানরত বাল্কপণ্যবোঝাই অন্যান্য মাদার ভ্যাসেল জাহাজকেও একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অথচ নির্ধারিত সময়ের পর বন্দরে অবস্থানের কারণে জাহাজগুলোকে প্রতিদিন সর্বনিম্ন ১০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হয় বলে জানিয়েছেন শিপিং কোম্পানির ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম বন্দর ভবন
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলনের কারণে আমদানি-রফতানিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। সরকার শুধুমাত্র রাজস্ব পায়নি তা কিন্তু নয়, জাহাজগুলো নির্ধারিত সময়ে বন্দর থেকে যেতে না পারায় জরিমানা গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি শুল্কায়ন না হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী পণ্য যথা সময়ে জাহাজে উঠাতে পারেননি। অনেক জাহাজ হয়তো পণ্য না নিয়েই চলে গেছে। তখন দেখা যাবে সময়মতো পণ্য পাঠাতে না পারায় এসব পণ্যের অর্ডার বাতিল হয়ে যাবে। বলা যায় ব্যবসায়ীদের নানা ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলেছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। তাই আমার দাবি, বন্দর-কাস্টম; এগুলোকে জরুরি সেবার আওতায় আনা উচিত সরকারের। এখানে আন্দোলনের নামে জিম্মি করা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই সরকারের প্রতি দাবি থাকবে, ভবিষ্যতে এমন আন্দোলনের কথা মাথায় রেখে এ বিষয়ে আইন করা।’
চাপ বেড়েছে আইসিডিতে
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৯টি আইসিডিতে (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) কনটেইনার ধারণক্ষমতা এক লাখ ছয় হাজার ২০০ একক কনটেইনাররে। এর মধ্যে সোমবার পর্যন্ত ৮২ হাজার ৫৬ একক কনটেইনার রয়েছে ডিপোতে। যার মধ্যে ৫৮ হাজার ৪৭৬টি খালি। বাকিগুলো পণ্যভর্তি। শুল্ক বিভাগের ছাড়পত্র না পাওয়ায় সেগুলো যেতে পারেনি।
চট্টগ্রাম কাস্টম ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ড এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ ইমাম বিলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম কাস্টমে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ হাজার বিল অব এন্ট্রি ও বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল হয়। এর বিপরীতে দৈনিক ২৫০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে কাস্টমের। হয়তো আদায় হয় গড়ে ৩০০ কোটি টাকা। গত কয়েকদিন কাজ বন্ধ থাকায় সে রাজস্ব আদায় হয়নি। দেখা যাবে ৩০ জুন বছর শেষে এর প্রভাব পড়বে। তবে আন্দোলনের বেশি প্রভাব পড়েছে আমদানি-রফতানিতে। যথা সময়ে পণ্য জাহাজে উঠাতে না পেরে অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। এ ধরনের আন্দোলন কাম্য নয়।’
বন্দরে কনটেইনার জট
বন্দরের ইয়ার্ডগুলোতে একক কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮টি। তবে স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য প্রায় ৩৫ হাজার কনটেইনার থাকা প্রয়োজন। সোমবার ইয়ার্ডগুলোতে এর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪১ হাজার। স্বাভাবিক সময়ে বন্দর থেকে চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার খালাস হয়। আন্দোলনের কারণে শনিবার খালাস হয়েছে ১৩৯টি এবং রবিবার হয়েছে ৭৭৪টি। বাকিগুলোর জট লেগে গেছে।
জট কাটাতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রুহুল আমি সিকদার বলেন, ‘সোমবার সকাল থেকে আইসিডি থেকে কনটেইনার বন্দরে পাঠানো হচ্ছে। সাধারণত আইসিডিগুলোতে আট হাজার একক রফতানি কনটেইনার রাখা হয়। সেখান থেকে প্রতিদিন দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ একক কনটেইনার বন্দরে পাঠানো হয়। আন্দোলনের কারণে সোমবার পর্যন্ত রফতানি কনটেইনার বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৯৪৬টি। সৃষ্টি হওয়া এই কনটেইনার জট কাটাতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোমবার থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে। আশা করছি, কনটেইনার জটসহ যেসব সমস্যা আছে, তা শিগগিরই কেটে যাবে। দু’একদিনের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে এই বন্দরের কাজকর্ম।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন