‘গত বছরের তুলনায় এবার চামড়ার দাম বেড়েছে। তবু সরকার নির্ধারিত রেটে চামড়া বিক্রি হচ্ছে না। চামড়ার দাম কম বলছেন ব্যবসায়ীরা। নানা টালবাহানায় দাম কম দেওয়ার চেষ্টা করছেন।’ কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুরের বাসন থানার জাহানারা সিদ্দিকিয়া মাদরাসার ছাত্র মাসুদুর রহমান।
শনিবার (৭ জুন) সারাদেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হচ্ছে। ভ্যান, পিকআপ, অটোরিকশাযোগে দুপুর থেকেই বিভিন্ন গন্তব্য থেকে চামড়া আসতে শুরু করেছে সাভারের আমিনবাজার সেতু সংলগ্ন অস্থায়ী চামড়া বেচাকেনার হাটে।
বিকেলে কথা হয় মাসুদুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১০ পিস চামড়া এনেছি। চামড়ার দাম বলা হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। এর মধ্যে দুই-তিন পিস চামড়া মৌসুমি ক্রেতারা নিতে চাইছেন না।’
মাসুদুরের মতো অন্য বিক্রেতা ও ফড়িয়াদের অভিযোগ, গতবারের তুলনায় দাম বেশি হলেও এখনো ন্যায্যদাম তারা পাচ্ছেন না।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতারা বড় গরুর চামড়া কিনছেন ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায়। আর মাঝারি গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। অন্যদিকে ছাগল ও ভেড়ার চামড়া বিক্রি হচ্ছে পাঁচ থেকে ১৫ টাকায়। কেউ আবার বড়ছোট নয়, গড় করে ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকায় কিনছেন।
বিক্রেতাদের দাবি, এবার ভালো দাম পাচ্ছেন ক্রেতারা। সংরক্ষণ খরচ, লবণ দেওয়া, ভাড়া ও পরিবহনসহ একটি চামড়ার পেছেন তাদের আরও ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ হচ্ছে। অন্যদিকে ল্যাম্পিরোগযুক্ত চামড়া ও ছেড়া-ফাটা চামড়াও তাদের কিনতে হচ্ছে, যা ট্যানারিতে বিক্রি করা যাবে না।
আমিনবাজার সেতুর কাছেই সালেহপুর তাহসিমুল উলুম ইসলামিয়া মাদরাসা। সেখান থেকে ৩৪টি গরুর চামড়া এনেছেন তিনজন। মাদরাসাটির ছাত্র জয়নুল আবেদিন বলেন, ৮৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। দাম আরেকটু বেশি হওয়া উচিত ছিল।
মাদরাসাছাত্র মাসুদুরের মতে, দাম বাড়লেও চামড়া সিন্ডিকেট ভাঙেনি। তিনি বলেন, ‘গতবারের তুলনায় দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি এটা সত্য। তবে আগের মতোই সিন্ডিকেট চালু আছে। সরকার আবার ব্যবসায়ীদের লবণ দিচ্ছে বিনামূল্যে। আগেও আমরা প্রতিপিস চামড়া দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বিক্রি করেছি। পরবর্তীতে আওয়ামী সরকারের আমলে চামড়ার দাম কমে যায়।’
‘সেই হিসাবে চামড়ার দাম অনেক কম। আর নয়-ছয় বুঝিয়ে চামড়ার দাম কমানোর চেষ্টা আছে। ঠুনকো অজুহাতে আমার তিনটা চামড়া নিচ্ছে না।’, যোগ করেন মাসুদুর।
গত ২৫ মে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর চামড়ার নতুন দাম নির্ধারণ করে সরকার। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম এক হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ১৫০ টাকা। এছাড়া খাসির চামড়ার ক্রয়মূল্য প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আমিনবাজার সেতু সংলগ্ন সড়ক, ফুটপাতেই চামড়া বিকিকিনি হচ্ছে। আগে যে মাঠে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে সেই মাঠ পুরোটাই কর্দমাক্ত। চামড়া বিক্রি হওয়ার আগেই কাউকে কাউকে আবার চামড়ার গায়ে থাকা মাংস, চর্বি, কান কেটে নিতে দেখা গেছে।
কয়েকজন মৌসুমি ক্রেতাকে বেছে বেছে চামড়া কিনতে দেখা গেলো। ভালো দাম নিয়ে কিছু ক্রেতাকে সাভার ট্যানারির দিকে ছুটতে দেখা গেছে। মৌসুমি ক্রেতারা বলছেন, এবার কোরবানি কম হয়েছে। তারা বিক্রেতাদের ভালো দাম দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
রাকিব নামে একজন বলেন, ‘ছাগলের চামড়া নিচ্ছি না। বড় গরুর চামড়া কিনছি ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায়। এবার কোরবানি কম হওয়ায় চামড়া আসছে কম।’
অর্ধশতাধিক ছাগলের চামড়া কিনেছেন স্বাগতা চৌধুরী। তিনি বলেন, ছাগলের চামড়া কিনছি পাঁচ থেকে ১৫ টাকায়। এবারও ছাগলের চামড়ার দাম নেই। অনেকেই না বিক্রি করে ফেলে দিচ্ছেন।’
‘ছাগলের চামড়ার প্রসেস করতে অনেক কষ্ট। নিজেদের ট্যানারি আছে দেখে কিনছি। অন্য কেউ নিচ্ছে না।’ দাম কম হওয়া প্রসঙ্গে বলেন তিনি।
আরেক বিক্রেতা বলেন, ‘এইমাত্র একটা মাদরাসার কাছ থেকে ২০ পিস চামড়া নিলাম ৮০০ টাকা গড়ে। এর মধ্যে ডিফেক্ট চামড়া পড়লে আমার লস।’
মৌসুমি ক্রেতা আবদুর রহিম বলেন, ‘এবার চামড়ার দাম ভালো। ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায় আমরা কিনছি। আমাদের আরও ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ আছে প্রতি চামড়ায়। প্রতিপিস চামড়ায় আমাদের খরচ ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা। আবার বিক্রি করতে গেলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ চামড়া বাদ দেওয়া হয়। আমরা যতই ছেকে ছেকে চামড়া নেই, কোম্পানি আরও বেছে নেয়। বিক্রেতারা চামড়ার দাম ভালো পাচ্ছে। শুধু রোগযুক্ত চামড়া সমস্যা। তা না হলে দাম ভালো।’
তিনি বলেন, ‘চামড়ায় দাগ, ছেড়া-কাটা থাকলে দাম হয় না। অথচ ক্রেতা বলে তিন লাখ টাকার গরুর চামড়ার দাম নাই। ভালো মানের চামড়া হলে ক্রেতা ভালো দাম পাচ্ছে।’