রাজধানীতে গত ৯ মাসে ৪৯২টি বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা ছিল ৩৭৮। একই সঙ্গে মেডিকেল কলেজগুলোর মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য যাওয়া লাশের সংখ্যাও বাড়ছে।
ঢাকা মেডিকেল, স্যার সলিমুল্লাহ ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গ এবং আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে বেওয়ারিশ লাশ দাফনকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাদের দুজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
সারাদেশ থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নানা স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পা রাখেন। পড়ালেখার জন্য কিশোর-তরুণরা আসেন রাজধানীতে। নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ্যতা অনুযায়ী যে যার মতো কর্মসংস্থান খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেন। স্বপ্ন ছুঁতে এই নগরীতে এসে অনেককে লাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়। কেউ প্রাণ হারান ছিনতাইকারীর হাতে, কেউ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে খুন হন। আবার কারও মৃত্যু হয় সড়ক, অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায়। নানা কারণে আত্মহননের পথও বেছে নেন কেউ কেউ। মৃত্যুর পর এদের অনেকের পরিচয় জানতে পারে না পুলিশ। তারা বেওয়ারিশ হিসেবে চিহ্নিত হন।
বেওয়ারিশ লাশ বেড়ে যাওয়াকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অন্যতম সূচক হিসেবে দেখা হয় অপরাধ বিজ্ঞানে। এর অর্থ, অপরাধীরা খুন করে চলে যাচ্ছে। হত্যার শিকার মানুষের পরিচয়ও জানা যাচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের দিক থেকেও চাপ কম থাকে। ফলে অপরাধীরা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও পার পেয়ে যায়।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন সেবা কর্মকর্তা কামরুল আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘আমরা মর্গ, হাসপাতাল এবং থানা পুলিশের কাছ থেকে এ ধরনের লাশ গ্রহণ করে সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে নিয়ে দাফন করি। নবজাতক থেকে শুরু করে সব বয়সের লাশ আমাদের কাছে আসে।’
ঢাকায় লাশের ময়নাতদন্ত হয় তিনটি মর্গে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের (মিটফোর্ড) মর্গে। রাজধানী কিংবা ঢাকা জেলার আওতাধীন এলাকায় খুন এবং নানা দুর্ঘটনায় নিহতদের ময়নাতদন্ত হয় এসব মর্গে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রাজধানীর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে তাদের লাশও এসব মর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়।
মূলত থানায় মামলা হয় এমন সব ঘটনার ক্ষেত্রে লাশের ময়নাতদন্ত হয়ে থাকে। আর কোথাও বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার হলে পুলিশ মামলা করে। তখন সেসব লাশের ময়নাতদন্ত হয়। এর বাইরে অনেক মৃত্যুর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্বজনরা ময়নাতদন্ত করতে চান না। তাই সেসব মৃত্যুর হিসাব এই প্রতিবেদনে নেই।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, যেসব অজ্ঞাতপরিচয় লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায়, সেগুলো আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তি করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অশনাক্ত বেওয়ারিশ লাশ অনেক সময় মর্গে থাকে। এসব ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুলিশ।
গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকার তিন মর্গ থেকে ৪৬৮টি বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। ৩০ সেপ্টেম্বরের আগে আসা আরও ২৪টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে এখনও আছে। সে হিসাবে গত ৯ মাসে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা ৪৯২টি। ২০২৩ সালের একই সময়ে ৩৭৮টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয় বলে জানায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। ২০২৩ সালের তুলনায় বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা ১১৪টি বেশি।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. উমর ফারুক সমকালকে বলেন, বেওয়ারিশ লাশ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি। লাশ বেওয়ারিশ থাকলে পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে পুলিশ কম পরিমাণ চাপ অনুভব করে। অপরাধীরা একে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থান মনে করে।
৯ মাসে দুই হাজার ৮২১ লাশের ময়নাতদন্ত
তিনটি মর্গ থেকে লাশের ময়নাতদন্তের তথ্য সংগ্রহ করেছে সমকাল। সে হিসাব বলছে, হিমঘরে লাশের সংখ্যা বাড়ছে। গত ৯ মাসে এই তিন মর্গে দুই হাজার ৮২১টি লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৯২টি বেওয়ারিশ লাশ। ২০২৩ সালের একই সময়ে ময়নাতদন্ত হয়েছিল দুই হাজার ৬৬০টি মৃতদেহের। ২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর ১৬১টি লাশ বেশি এসেছে মর্গে। আর অভ্যুত্থানের বছর ২০২৪ সালের প্রথম ৯ মাসে তিন হাসপাতালে দুই হাজার ৮০৩টি লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছিল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে রাজধানীতে ১৮০ জন খুন হয়েছেন। এ ছাড়া গত ১ অক্টোবর থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত রাজধানীতে খুন, আত্মহত্যা ও সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভন্ন ঘটনায় অন্তত ১৫ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম ৯ মাসে ঢাকা মহানগরীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯১৩ জন। ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮৮৯ জন। দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে অনেকের ময়নাতদন্ত হয় শহরের তিন মর্গে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গসংশ্লিষ্ট একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় গলায় ফাঁস বা বিষপানে মারা যাওয়া অনেক লাশ আগে এই মর্গে নিয়ে আসা হতো। বছরখানেক ধরে এ ধরনের মৃতদেহ কম আসছে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, আত্মহত্যার ঘটনায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই অনেকে পুলিশের কাছে আবেদন করে লাশ নিয়ে যায়। অবশ্য আগেও ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফন করা হতো। তবে এখন এ সংখ্যা বেড়েছে।
ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন
অনেকে থানায় আবেদন করে ময়নাতদন্ত ছাড়া স্বজনের লাশ নিয়ে যান। সাধারণত আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, ভবন থেকে পড়ে এবং পানিতে ডুবে মৃত্যুর ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটে। তারা স্বজনের লাশ কাটাছেঁড়া করতে চান না।
এসব লাশের হিসাব মর্গে থাকে না। ফলে মর্গে ময়নাতদন্তের সংখ্যা লাশের প্রকৃত সংখ্যা নয়। আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এক দিনে তিন মরদেহ উদ্ধার
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় ঈদগাহ মাঠ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ এলাকায় মরদেহগুলো পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে দুজনের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। অজ্ঞাত হিসেবে লাশ মর্গে রাখা হয়েছে।
পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে, তিনজনই ভবঘুরে ছিলেন। রাতে ফুটপাতে ঘুমাতেন। শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর জানান, শরীরে আঘাতের চিহ্ন না থাকায় অসুস্থতার কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশের ফুটপাতে এক নারীকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর বয়স আনুমানিক ৫৫ বছর।
জাতীয় ঈদগাহ মাঠের পাশের ফুটপাত থেকে রাত ৯টার দিকে এক ব্যক্তিকে (৪০) অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। পরে জানা যায়, তাঁর নাম আশরাফ মণ্ডল। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় তাঁর বাড়ি।
অন্য ঘটনায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের ফুটপাত থেকে এক ব্যক্তিকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। রাত ১২টার দিকে তাঁকে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর পরিচয় জানা যায়নি।
গত রোববার রাজধানীতে দুজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর মধ্যে গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশনের উত্তর পাশে এক তরুণীর গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। হত্যার আগে তাঁকে ধর্ষণ করা হতে পারে বলে প্রাথমিক ধারণা পুলিশের। মেয়েটির পরিচয় না মেলায় লাশ রাখা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে।
৩ অক্টোবর হাজারীবাগের বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ ছিলেন ওমর ফারুক মোল্লা নামে এক তরুণ। ৫ অক্টোবর সকালে ধানমন্ডি লেকে লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয় লোকজন থানায় খবর দেয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে।
একই দিন রমনা পার্ক, গেণ্ডারিয়া ও হাজারীবাগ থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক সমকালকে বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসে। অনেকে যে প্রান্তিক অবস্থায় আসে, সে অবস্থাতেই থেকে যায়। কখনও নানা ধরনের বিপর্যয় তৈরি হয়। এই বিপর্যয় থেকে আত্মহত্যা, খুনের ঘটনা ঘটে।
অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি এবং সেই সুযোগের ভিত্তিতে জীবনযাত্রার মান উন্নত করার প্রচেষ্টা সমভাবে করতে পারবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত রাজধানীকেন্দ্রিক মানুষের চাপ বাড়বে। রাষ্ট্র জনগণের বৈশিষ্ট্য ও সক্ষমতার আলোকে ন্যূনতম মর্যাদার জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য সুযোগ-সুবিধাগুলো দেশের সব জায়গায় সমভাবে বণ্টন করতে পারেনি। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে লাশের সংখ্যা বাড়বে, অপমৃত্যু বাড়বে।
সুত্র: সমকাল