নকশাসহ নানা জটিলতায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীতকরণ কাজে হবিগঞ্জের বাহুবল অংশে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে চুক্তির মেয়াদও পার করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। বর্তমানে আঁকাবাঁকা মহাসড়কটিতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এছাড়া দীর্ঘদিন সড়কে কাজ চলমান থাকায় দুর্ভোগে পড়েছে এলাকাবাসী।
একদিকে রাস্তার নকশা পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন কয়েকজন। অপরদিকে ভূমিহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কায় নকশা ঠিক রেখে রাস্তা করার দাবি স্থানীয়দের। এ অবস্থায় মহাসড়কের কাজ প্রায় থমকে রয়েছে। ফলে আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে একদিকে যেমন বাড়ছে দুর্ঘটনা, অরপরদিকে বাড়ছে দুর্ভোগও।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৬ লেন কাজের বাহুবল উপজেলার মর্দিলং ব্রিজ থেকে সদরঘাট গেইট পর্যন্ত প্রায় ১৮ কিলোমিটার অংশের কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিপিসিএল জেভি। এ অংশের রাস্তা পুরোটাই আঁকাবাঁকা। ফলে এটি অত্যন্ত দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। তাই রাস্তাটি সোজা করে রাস্তার নকশা তৈরি করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তির আপত্তির কারণে রাস্তার কাজটি আটকে যায়।
এ বিষয়ে সম্ভুপুর গ্রামের তপন পাল বলেন, ‘একজনের স্বার্থে রাস্তাটি বাঁকা করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে আমরা শুনতে পেরেছি। অথচ রাস্তা বাঁকা হলে এখানে দুর্ঘটনা বেড়ে যাবে। এছাড়া পূর্ব দিকে মানুষের বাড়িঘর। ঘনবসতি। সেদিকে রাস্তা নিলে মানুষের মারাত্মক ক্ষতি হবে।’
একই গ্রামের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের এখানে রাস্তা অনেক আঁকাবাঁকা। ফলে এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। রাস্তাটি যদি পশ্চিমদিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নকশা অনুযায়ী নেওয়া হয়, তাহলে সেটি সোজা হবে। রাস্তা সোজা হলে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে। পূর্ব দিকে নিলে আরও বাঁকা হবে। আরও দুর্ঘটনা বাড়বে। তাছাড়া পূর্বদিকে আমাদের এলাকার একমাত্র প্রাথমিক স্কুল, ঈদগাহ ও মক্তবটি ভাঙা পড়বে। এতে শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে পড়বো। মানুষের বাড়িঘরও ভাঙবে। কেউ কেউ মাত্র এক থেকে দেড় শতাংশ জমিতে কোনো রকমে একটি ঘর বানিয়ে বসবাস করছে। তারা নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’
মো. ইউনুছ মিয়া বলেন, ‘আমরা ৫ ভাই, মাত্র ৯ শতাংশ জমি। একেকজন মাত্র ২ শতাংশের চেয়েও কম জমি নিয়ে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছি। যদি রাস্তাটি পূর্ব দিকে নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের বাড়িঘর চলে যাবে। আমরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়বো। এমন আরও অসংখ্য পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’
রতন পাল বলেন, ‘যে মন্দির বা বটগাছটি রক্ষা করার জন্য রাস্তাটি আরও বাঁকা করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে সেটি এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ মন্দির নয়। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে আমাদের আলাদা মন্দির তৈরি করে দেওয়া হবে। অপরদিকে পূর্ব পাশে রাস্তা গেলে আমাদের বাড়িঘর থাকবে না। আমাদের যদি বাড়িঘরই না থাকে তাহলে মন্দির দিয়ে কী করবো। পরিবার পরিজন নিয়েতো মন্দিরে বসবাস করতে পারবো না। মানুষ যদি না থাকে তাহলে মন্দিরে কে পূজা দেবে। আমরা চাই রাস্তাটি সোজা হোক। দুর্ঘটনা হ্রাস পাক। পাশাপাশি মানুষের বাড়িঘর রক্ষা পাক।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিপিসিএল নিয়োজিত প্রকৌশলী সালাহ উদ্দিন কাদের বলেন, মহাসড়কের নকশা করা হয়েছে সার্বিক বিবেচনায়। এখানে পশ্চিম পাশে হাওর এলাকা। তাই সেদিকে ক্ষতি কম হবে। আর পূর্বদিকে ঘনবসতি সেদিকে অধিগ্রহণ করলে ক্ষতি বেশি হবে। তাছাড়া রাস্তাটি সোজা করতে হলে পশ্চিম দিকেই যেতে হয়। পূর্বদিকে গেলে অধিক পরিমাণ জমি লাগবে। এসব বিবেচনায় নিয়েই মূলত নকশাটি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের প্যাকেজটি হচ্ছে মর্দিলং ব্রিজ থেকে সদরঘাট গেইট পর্যন্ত। তার মধ্যে মর্দিলং থেকে পুটিজুরির অর্ধেক পর্যন্ত এসে যৌথ জরিপ থেমে আছে প্রায় ৬ মাস ধরে। এসময়ে আমাদের প্রজেক্ট প্রায় শেষ হয়ে যেত। ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে আমাদের সময় গণনা শুরু হয়েছে। এর ২৭০ দিনের মধ্যে আমাদের জমি বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রায় ২ বছর হতে চললেও আমরা এখনো জমি পাইনি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কাজটি করার জন্য ২০০ লোক দরকার। সেই লোকবল বসিয়ে রেখে বেতন দিচ্ছি, যন্ত্রপাতি এনে ফেলে রেখেছি। কন্ট্র্যাক্ট ভায়োলেশনও হচ্ছে। দ্বিতীয়ত সড়ক বিভাগের খরচ বাড়বে। কারণ যত দিন যাবে ততোই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম অনুযায়ী আমাদের চুক্তির টাকাও বাড়বে। এটি চুক্তিতেই বলা আছে। রাস্তার কাজ বিলম্ব হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ মারাত্মকভাবে বাড়ছে। দুর্ঘটনাও বাড়ছে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৬ লেন কাজের বাহুবল উপজেলার পুটিজুরি অংশের প্রজেক্ট ম্যানেজার সৈয়দ গিয়াস উদ্দিন বলেন, দীর্ঘ গবেষণার পর রাস্তার নকশা তৈরি করা হয়েছে। চাইলেই সেই নকশা পরিবর্তন করা যায় না। বাহুবল উপজেলার কল্যাণপুর মৌজায় একটি মন্দির পড়েছে রাস্তায়। সেটি আমরা অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার জন্যও প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু মন্দিরটি যে বাড়িতে পড়েছে তারা বাধা দেওয়ার কারণে রাস্তাটির কাজ করা যাচ্ছে না। আমরা বিষয়টি লিখিত আকারে জানিয়েছি। জমি অধিগ্রহণ করে দেওয়ার জন্যও লিখিত দিয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো উত্তর পাইনি।
তিনি বলেন, জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে সরকার। আর আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবো। জমি বুঝে পাওয়ার আগে কাজ করা সম্ভব নয়। কাজ যত বিলম্ব হবে ততো মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
জেলা প্রশাসক ড. মো. ফরিদুর রহমান বলেন, ছয়লেন প্রকল্পের অধীনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক যেটি হচ্ছে সেখানে হবিগঞ্জ অংশে ৮১ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। এখানে প্রায় ৩০১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে ৩০টি এলএ কেসের মাধ্যমে। খুব দ্রুত কাজ হচ্ছে। এরইমধ্যে আমরা ৪টি কেস বুঝিয়ে দিয়েছি। পুটিজুরি অংশটি নিয়েও কাজ চলছে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা জমি হস্তান্তর করতে পারবো আশা করি। এখন কোনো জটিলতা নেই। সড়ক বিভাগ থেকেই নকশা করা হয়েছে। সে অনুযায়ীই কাজ হবে। আশা করছি দ্রুতই মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হবে।
সূত্র: জাগো নিউজ