নিউ ইয়র্কে মেয়র পদপ্রার্থী জোহরান মামদানি যেন এক অসাধারণ রাজনৈতিক বিপ্লবের নির্মাতা। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী, ব্যয়বহুল এবং সবচেয়ে বেশি ধনবৈষম্যের শহর —নিউ ইয়র্ক। সেই নগরে ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন জিতেছেন উগান্ডায় জন্ম নেওয়া মুসলিম বংশোদ্ভূত মামদানি। বিষয়টি যত সরল শোনায়, ঘটনাপ্রবাহ মোটেই ততটা সহজ নয়। বিশ্বের ডান ও বাম—দুই ধারার সংবাদমাধ্যমই মামদানির এই বিজয়কে ব্যাখ্যা করছে নানা বিশেষণে: ‘রাজনৈতিক ভূমিকম্প’, ‘বৈপ্লবিক পরিবর্তন’, ‘সমাজতান্ত্রিক উত্থান’, ‘নতুন তারকা’ ইত্যাদি। এমনকি সকলে এ কথাও স্বীকার করছেন যে, আসন্ন নভেম্বরে তিনি মেয়র নির্বাচনে জিততে না পারলেও, অগণিত বাধার পাহাড় টপকে তার এই বীরোচিত উত্থান আমেরিকার সামগ্রিক রাজনীতিতে রেখে যাবে স্থায়ী দাগ, দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব। ফলে মামদানি ইতিমধ্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত, চব্বিশ ঘণ্টার নির্ঘুম নগরে (দ্য সিটি দ্যাট নেভার স্লিপস) অনন্য এক গণনায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
মামদানিকে প্রতিহত করার জন্য ধনিকগোষ্ঠি ও জায়োনবাদীরা বিপুল অর্থব্যয় ও হুমকিসহ সকল কৌশল প্রয়োগ করছে। এমনকি বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত ’কমিউনিস্ট মামদানি’কে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। আর মামদানি জবাবে বলেছেন, “আমি হচ্ছি ট্রম্পের রাত্রিকালীন দুঃস্বপ্ন।” এমনকি গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যারা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন তাদের ভোটও জিতে নিচ্ছেন মামদানি। অন্যদিকে ইসরায়েলি শহর তেল আবিবের পর নিউ ইয়র্ক হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ইহুদি অধ্যুষিত শহর। সেখানকার ট্রাম্পপন্থী ও জায়োনবাদীরা সকল অপকৌশল প্রয়োগ করছে তাকে ঠেকানোর জন্য। তিনি নাকি হামাসের সমর্থক, এমনকি বিশ্বব্যাপী ইন্তিফাদার প্রচারক ও জিহাদি। তারপরও গাজায় ইসরায়েল সংঘটিত গণহত্যার সরাসরি বিরোধিতা ও ট্রাম্পের কঠোর সমালোচনা করেও তিনি শহরটিতে ব্যাপক সমর্থন জয় করে নিচ্ছেন।
ধর্ম-জাতি-গোষ্ঠি নির্বিশেষে তরুণদের কাছে তারকাতুল্য এই ৩৩ বছর বয়সী রাজনৈতিক নেতা— মামদানি। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তার নির্বাচনি সব প্রতিপক্ষ এখন একজোট হওয়ার পরিকল্পনা করছেন। মেয়র পদপ্রার্থী জিম ওয়ালডেন নির্বাচনি দৌড় থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এবং একজন বাদে সব প্রার্থীকে একইভাবে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান করছেন অপ্রতিরোধ্য মামদানিকে ঠেকানোর জন্য। তিনি সতর্ক করছেন সবাইকে এই বলে যে, এর অন্যথা হলে এক ট্রোজান ঘোড়া দখল করে নেবে তাদের প্রিয় শহর। মামদানি কেবল ট্রাম্পেরই নয়, নিউ ইয়র্কের সব দুর্নীতিগ্রস্ত, ধনিকগোষ্ঠির পা-চাটা ও যুদ্ধবাজদেরই রাত্রিকালীন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছেন। তিনি ও তার সমর্থকরা এতে ভীত তো ননই, বরং উপভোগ করছেন প্রতিপক্ষগুলোর এসব সার্কাস। তাকে সমর্থন করা বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের মধ্যে আছেন বার্নি স্যান্ডার্স, এজিাবেথ ওয়ারেন, আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাশিয়ো-কোর্তেজ, এমনকি মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যাড ল্যানডার এবং জুয়িশ ভয়েস ফর পিস অ্যাকশন ও দ্য জুয়িশ ভোটসহ অনেক বৈচিত্র্যময় পক্ষ।
৪ নভেম্বরের নির্বাচনে জিতলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভারতীয় চলচ্চিত্রকার মীরা নায়ার ও ভারতীয়-উগান্ডান অধ্যাপক মাহমুদ মামদানির পুত্র জোহরান মামদানি হবেন নিউ ইয়র্কের প্রথম মুসলিম ও প্রথম দক্ষিণ এশীয় মেয়র। আবার তিনি হবেন একশো বছর পর আবার নিউ ইয়র্কে আরেক সমাজতান্ত্রিক মেয়র এবং একশো বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী।
কেমন করে তা সম্ভব হলো সেটি কৌতূহলোদ্দীপক। কেননা তিনি ছিলেন নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির একেবারেই অপরিচিত একজন সদস্য। সেই অবস্থা থেকে নিউ ইয়র্কের বাঘা বাঘা বর্তমান ও সাবেক মেয়রদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে মাত্র আট মাসের মধ্যে বিশ্বের সবচাইতে পরিচিত মুখগুলোর একটিতে পরিণত হওয়াটা বিস্ময়ের। পত্রপত্রিকায় তার এ নির্বাচনি সাফল্যের কারণ হিসেবে নানা বিষয় উঠে এসেছে। নির্বাচনি প্রচারণার ভিডিওতেই তিনি নতুনত্ব ও চমক এনেছেন। টার্গেট করেছেন নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ এশীয় বাসিন্দাদের যাদের সংখ্যা শহরটিতে উল্লেখযোগ্য, প্রচারণায় ব্যবহার করছেন ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, উর্দু, বাংলা ও অন্যান্য ভাষা। তার সঙ্গী এখন ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক যারা ইতিমধ্যে ১৬ লাখ দরোজায় কড়া নেড়েছেন।
আর তিনি বলছেন একেবারে শ্রমজীবী মানুষের কথা। তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিসমূহ সমাজতান্ত্রিক। তিনি বাড়ি ভাড়া বাড়ানো বন্ধ করে ও খারাপ বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ভাড়াটিয়াদের স্বার্থরক্ষার কথা বলছেন। তিনি ভাড়ামুক্ত বাস সার্ভিস চালু করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সাশ্রয়ী দামে পণ্য বিক্রির জন্য শহর কর্তৃপক্ষের অধীনে মুদি দোকান চালু করবেন ও বিনামূল্যে শিশু পরিচর্যা প্রদানের ব্যবস্থা করবেন। মোট কথা, সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরে সাশ্রয়ী মূল্যে প্রত্যেকের জীবনযাপন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি তার নির্বাচনি অভিযানের মূল দিক। এসব নানামুখী উদ্যোগ ছাড়াও তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির মধ্যে আছে ট্রাম্প-প্রুফ নিউ ইয়র্ক নির্মাণের পরিকল্পনা যাতে বলা হয়েছে: ডনাল্ড ট্রাম্প নিউ ইয়র্ক সিটির মূল কাঠামোকে তার দ্বিতীয় মেয়াদে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছেন। ... এবং তিনি প্রতিদিন নিউ ইয়র্কের কর্মজীবী মানুষের জন্য নির্ভরযোগ্য জরুরি সামাজিক সেবাগুলোর বিরুদ্ধে হুমকি দিয়েছেন। জোহরান মামদানি শ্রমিক শ্রেণীর ওপর ট্রাম্পের লুটপাটের চেষ্টাগুলোকে প্রতিহত করবেন এবং এমন একটি শহর উপহার দিবেন যেখানে প্রত্যেকে সম্মানজনক জীবনযাপনের সামর্থ্য রাখবে।
মামদানির এই উত্থান ইতিহাস-বিচ্ছিন্ন নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রে বয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক সমাজতান্ত্রিক হাওয়ার বহুকাঙ্ক্ষিত ফসল। তিনি ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার (ডিএসএ) সদস্য। ২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাটিক দলের পক্ষ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোয়নপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্সের নির্বাচনি অভিযানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মামদানি নিজেকে গড়ে তুলেছেন। স্যান্ডার্স তার একটি এক্স পোস্টে উল্লেখ করেছেন, “মামদানির নির্বাচনি অভিযানের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হলো, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাধররা তাকে এত বেশি ভয় পায়। তারা জানে, তিনি জিতলে সারা দেশের মানুষ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে অলিগার্কদের অর্থাৎ অল্পসংখ্যক কর্তৃত্ববাদীদের ক্ষমতার অবসান ঘটাতে অনুপ্রাণিত হবে।“
বার্নির এরূপ আশাই ঘুম হারাম করে দিচ্ছে এই অল্পসংখ্যক কর্তৃত্ববাদীদের নেতা ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার অনুসারীদের। ওয়ালডেনের পরামর্শই এখন তাদের একমাত্র ভরসা। মামদানিকে হারাতে শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে নেমেছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরামর্শদাতারা। দুর্নীতিগ্রস্ত ও যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত অ্যান্ড্রু কুমোকে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে রেখে বাকি সবাইকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য তারা নানারকম লোভ দেখাচ্ছেন। বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস ও আরেক পিছিয়ে পড়া প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে তারা হোয়াইট হাউসে কোনো প্রশাসনিক পদ দেওয়ার ফন্দি আাঁটছেন।
এ ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ হওয়ার পরপর মামদানি তার সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে লিখেছেন: “আজকের সংবাদ নিশ্চিত করছে যে, ট্রাম্পের মনোনীত মেয়র প্রার্থী কুমো।“ স্যান্ডার্স প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এভাবে: “নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচন প্রতিযোগিতা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার এক দুর্দান্ত উদাহরণ।“ তিনি বলেছেন, তার বিরুদ্ধে কেবল অলিগার্ক অর্থাৎ মুষ্টিমেয় কর্তৃত্ববাদী ও জায়োনবাদীরাই নেই, আছেন ডেমোক্র্যাটিক দলের একই চরিত্রের নেতৃবৃন্দও। তবু তার প্রতিজ্ঞা এইসব অশুভ শক্তিকে পরাজিত করেই “আমরা জোহরানকে মেয়র নির্বাচন করব।“ (মামদানি রিজেক্টস কোরাপ্ট পলিটিক্স অ্যান্ড ব্যাকরুম ডিলস আফটার লেটেস্ট ট্রাম্প-কুমো রেভিলেশনস, ব্র্যাড রিড, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, কমন ড্রিমস)
যদিও অ্যাডামস ও স্লিওয়া এখনও ট্রাম্প গংদের প্রস্তাব গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেননি, বরং তারা জোরেশোরেই নির্বাচনি প্রতিযোগিতায় থাকতে চান, কতক্ষণ প্রতিজ্ঞায় অটল থাকতে পারবেন সেটাই প্রশ্ন। ট্রাম্প-কুমো গোষ্ঠির স্বপ্নপূরণ নির্ভর করছে এ দুজন প্রার্থীর টলে যাওয়া বা না যাওয়ার ওপর। তবে মামদানি জিতুন আর না জিতুন—নির্ঘুম নিউ ইয়র্ক শহরের এই দক্ষিণ এশীয় বাঁশিওয়ালা যে ট্রাম্প ও তার মুষ্টিমেয় কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠিরও ঘুম কেড়ে নিয়েছেন তা এখনই এক ঐতিহাসিক বিজয়।
সূত্র: বিডি নিউজ