অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্ম। সঙ্গত কারণেই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণকারীরাই এই সরকারে স্থান পেয়েছেন, এটাই বিশ্বাস করতে হবে। আরও বিশ্বাস করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন, দুর্নীতিগুলো দূর করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরিতে এই সরকার সর্বত্র আন্তরিক। বিশ্বাসের পেছনে যৌক্তিক কারণও আছে। প্রথম কথা হচ্ছ, এই সরকার রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ না করলেও সর্বদলীয় সরকার হিসেবে সহজেই দাবি করতে পারে। কারণ এই সরকার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছোটবড় সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। আরও স্পষ্ট করে বললে, এ সরকার অভ্যুত্থানেরই ফসল।
সর্বদলীয় এই সরকার এ দেশের মানুষ দিয়েই গঠিত। সঙ্গত কারণেই তারা শতভাগ সফল নাও হতে পারে। এই অসফলতার বিষয়গুলো আলোচনাও হতে পারে। এবং এই সমালোচনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা নিজে। সেক্ষেত্রে ব্যাপক সমালোচনাও অন্যায্য নয়। কিন্তু তারা যদি অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু করেন এবং করতে থাকেন তখন সমালোচনার পরিবর্তে বিরোধিতাও অস্বাভাবিক নয়। আর সেই বিরোধিতার সুরই আমরা শুনতে পাচ্ছি বিভিন্ন মহল থেকে। সর্বশেষ একটি মন্তব্য মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছে। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম যখন বলেন, ‘উপদেষ্টাদের অনেকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তারা সেফ এক্সিট খুঁজছেন’ তখন আমাদের ভাবনাটা বাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট।
তার এই বক্তব্য কড়া বার্তা হিসেবে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেলেও উপদেষ্টাদের নিয়ে এমন মন্তব্য এটাই প্রথম নয়। কয়েকদিন আগে এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীও বলেছিলেন, ‘বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন’। তিনি দাবি করেন, অনেকের আত্মীয়-স্বজনের খবর আমরা পাচ্ছি। উপদেষ্টাদের কে কে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তা জনগণের সামনে প্রকাশ করবে এনসিপি। দুর্নীতিগ্রস্ত উপদেষ্টাদের শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে এনসিপি।’ নাহিদ ইসলাম এবং নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী দুজনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিনিয়র নেতা, একইসঙ্গে পরবর্তীকালে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিরও যথাক্রমে আহ্বায়ক ও মুখ্য সমন্বয়ক। দুজনের সমালোচনার ভাষা দেখে মনে হতে পারে দুজনই ক্ষুব্ধও। অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী দুজনেরও আগে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার।
তারা এমন কি করেছেন যে, তাদের সেফ এক্সিট খুঁজতে হবে? আবার অন্যরকম আলোচনারও সুযোগ আছে। এনসিপির বক্তব্য অনুযায়ী যেসব উপদেষ্টা আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন, তাদের পরিচিতি ও কৃতকর্মগুলো সময়মতো প্রকাশ করা হবে। আসলে এই সময়টা কখন? সবাই জানে এই সরকারের মেয়াদ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন পর্যন্ত। সেই হিসাবে মাত্র কয়েক মাস সময় আছে হাতে।
গত ৮ আগস্ট রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এক সেমিনারে প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন দুর্নীতি’র প্রমাণ নিজের কাছে রয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত এই সচিব বলেন, এই উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় না, বদলিও হয় না।’ সাবেক এই সচিব বিএনপি সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে অনেকেই একে রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবেও মনে করতে পারেন। কিন্তু সাবেক সচিব সাহেব নিজে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীও। যে মুহূর্তে এনসিপি নেতাদের মুখ থেকে এমন বক্তব্য এসেছে তখন বিষয়টির গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।
এ ধরনের আলোচনায় একবারে সেফ এক্সিটের মতো মন্তব্য আসার পর স্বাভাবিক কারণেই মানুষের মধ্যে নানান প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। তারা এমন কি করেছেন যে, তাদের সেফ এক্সিট খুঁজতে হবে? আবার অন্যরকম আলোচনারও সুযোগ আছে। এনসিপির বক্তব্য অনুযায়ী যেসব উপদেষ্টা আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন, তাদের পরিচিতি ও কৃতকর্মগুলো সময়মতো প্রকাশ করা হবে। আসলে এই সময়টা কখন? সবাই জানে এই সরকারের মেয়াদ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন পর্যন্ত। সেই হিসাবে মাত্র কয়েক মাস সময় আছে হাতে। আবার অন্যদিকে বলা যায়-অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স বছর পেরিয়ে গেছে সেই কবে। উপদেষ্টাদের কয়েকজন যদি দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকেন সেটা নিশ্চয়ই আজকাল পরশুই নয়। সেই তথ্যটা আগে প্রকাশ হওয়া কি প্রয়োজন ছিল না?
যে তিনজনের উক্তি উল্লেখ করা হলো তারা সবাই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সরকার গঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরমধ্যে নাহিদ ইসলাম সন্মানসহ উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন তার রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে। তেমনি যেসব উপদেষ্টাকে সন্দেহ করা হচ্ছে কিংবা যাদের দুর্নীতির প্রমাণ আছে, তাদের সেফ এক্সিটের ব্যবস্থা করাও যেতো। সেক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ হতো। সরকারও সমালোচনা থেকে রেহাই পেতো। সুতরাং সেই ‘সময়’র প্রসঙ্গটি আবারও সামনে চলে আসে।
এই উপদেষ্টা পরিষদে একাধিক পরীক্ষিত ব্যক্তি আছেন, যারা আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। উপদেষ্টাদের মধ্যে পণ্ডিত এবং সুনামের অধিকারী ব্যক্তিও আছেন। হয়তো বা এখনো তাদের গায়ে দাগ পড়েনি। সেসব গুণী মানুষগুলোও যে আজ সমালোচনার মুখে পড়ছেন। এই দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণসহ প্রকাশ না হওয়ায় পুরো উপদেষ্টা পরিষদই যে সন্দেহের আওতায় পড়ে যায়।
সাবেক উপদেষ্টা ও এনসিপি নেতাকে তারপরও সাধুবাদ জানাতে হয়, কারণ এই মন্তব্য আমি আত্মসমালোচনা বলে মনে করি। কারণ তিনি যাদের সমালোচনা করছেন তাদেরই একজন ছিলেন কদিন আগেও। শুধু অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ে সরকার গঠন না করে সবার মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন করায় হয়তো এককভাবে তিনি এর দায় নেওয়ার কথাও নয়। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমর্থক হিসেবে তাদের অনেক সময় সরকারি দল হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়, এটাও তিনি নিশ্চয়ই জানেন। সুতরাং কথিত সরকারি দল হিসেবে এমন সাহসী ভূমিকার জন্য তিনি যেমন ধন্যবাদ পাওয়ার কথা তেমনি সরকারের ইমেজ রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এটাও আশা করা যায়।
দুর্নীতি বিষয়ে নিয়মিত সংবাদ হচ্ছে। তবে সেখানে যে চিত্র দেখা যায়, এর সঙ্গে রাজনৈতিক মহল যেমন জড়িত তেমনি আমলারা। এটা সত্য আমলারা রাজনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া দুর্নীতি করে পাড় পেতে পারেন না। আবার রাজনৈতিক নেতারাও আমলাদের সহযোগিতা ছাড়া দুর্নীতি করার সুযোগ পান না। সুতরাং দুর্নীতির জন্য এককভাবে কাউকে দোষ দেওয়াটা কতটা যৌক্তিক তা ভাবনার বিষয়। আমলাদের বিষয়ে এনসিপি থেকে বহুবার বলা হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের পর পরই রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের নিজেদের লোকজনকে বসিয়েছে একবারে মাছ ভাগাভাগির মতো। এই বিষয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক হিসেবে খ্যাত মাহফুজ আলমও একটি পোস্ট দিয়েছেন। তার অঙ্গুলি নির্দেশ ছিল জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির প্রতি।
জনআলোচনাগুলোও কিন্তু মাহফুজ আলমের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে না। তাই এই দুর্নীতির কথা বলা হলো, তার জন্য এককভাবে একটি দল কিংবা একটি গোষ্ঠীকে দায় দেওয়ার সুযোগ কতটুকু। জুলাই অভ্যুত্থানে বড় অংশীদারদের সবাইকেই দেখা যায় এখানে। যাদের সবাই বলেছিলেন রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনবেন তারা। আত্মসমালোচনা হোক আর নিছক বক্তব্যই হোক-এগুলো প্রমাণ করে রাজনৈতিক নতুন ব্যবস্থা কায়েম হয়নি। সাধারণ মানুষ আশা করতে পারে-সেই নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হবে। আর তখনই বলা যাবে-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তেমন হলে সম্মানজনক বিদায় হবে সবারই। সেফ এক্সিট খোঁজার প্রয়োজন হবে না কারও জন্যই।
সূত্র: জাগো নিউজ