সর্বগ্রাসী মব ভায়োলেন্স বা জনতার হিংস্র শাসনে আজকের বাংলাদেশ এক ভয়ঙ্কর ও জরুরি বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। যার ফলে আইনের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার মতো ভয়ানক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এ এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা, যেখানে ন্যায়বিচার আর প্রমাণের ভিত্তিতে আদালতের রায়ে নয়, বরং গুজব, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক প্ররোচনায় উত্তেজিত জনতা ‘বিচারের দায়িত্ব’ ছিনিয়ে নেয় নিজেদের হাতে। এই ধরনের মব জাস্টিস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে অন্তর্বর্তী সরকারও নিয়ন্ত্রণ হারাবে।
সর্বশেষ ৪ সেপ্টেম্বর আদালতের ভেতরে মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছেন সাংবাদিক। অনেক দিন ধরেই আমরা ‘জুলাই বিভীষিকার’ মামলায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আদালত প্রাঙ্গণেই মারধরের শিকার হতে হচ্ছে—যা আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ (ICCPR)-এর ধারা ৯ ও ধারা ১০-এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ বাংলাদেশ এ সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে ২০০০ সালেই।
সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা সবচেয়ে শঙ্কাজনক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যর্থতা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অক্ষমতা—সব মিলিয়ে দেশের ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজগঠনের স্বপ্নের ওপর দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে আইন-আদালতকে উপেক্ষা করে জন্ম নেওয়া এই ‘জনতার শাসন’, দেশটাকে মবের মুল্লুকে পরিণত করতে চলেছে।
মব ভায়োলেন্সের শেকড় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের চেয়ে অনেক গভীরে প্রোথিত। এটি জাতির জন্মলগ্ন থেকেই চলতে থাকা বিশ্বাসহীনতা, জবাবদিহিহীনতা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেঙে পড়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। স্বাধীনতার ঠিক পর ১৯৭২ সালেই এর ভয়াবহ রূপ প্রকাশ পায়। মার্কিন সাময়িকী টাইম সে সময় রিপোর্ট করেছিল যে, আওয়ামী লীগ নেতা কাদের সিদ্দিকী ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের কাছে চারজনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আদালতের বিচারের তোয়াক্কা না করে প্রকাশ্যে নির্যাতন ও শেষ পর্যন্ত বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে দিয়ে হত্যা করেন। হাজার হাজার মানুষ এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন, এমনকি পশ্চিমা সাংবাদিকরাও ছিলেন সাক্ষী।
স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলোতেই রাষ্ট্র একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারত, তবে হয়তো পরিস্থিতি এত ভয়াবহ রূপ নিত না। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকারগুলো—রাজনৈতিক রং যাই হোক না কেন—ন্যায়বিচারের দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। অধিকন্তু গুম, হত্যায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো ব্যবহারের নজির বাড়িয়েছে পাল্লা দিয়ে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে। এসবই গণহিংসার সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে বৈধতা দিয়েছে, আদালতের কর্তৃত্বকে দুর্বল করেছে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বৈধতাকে ক্ষয় করেছে। সবশেষে মব বাহিনী প্রেশার গ্রুপে অভিহিত করার মতো ঘটনাও দেখতে হচ্ছে আমাদের।
এই দীর্ঘ অবক্ষয় বিগত বছরের অগাস্ট থেকে ভয়ঙ্কর মাত্রায় বিস্ফোরিত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার বলছে, ৮ অগাস্ট ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত মব ভায়োলেন্সে ১০৮ জন নিহত হয়েছেন।
ঘটনাগুলোর নির্মমতা ও ঘনঘন সংঘটন ভীতিকর মাত্রায় পৌঁছেছে। উদাহরণস্বরূপ, গত ৯ অগাস্ট রংপুরে চোর সন্দেহে জনতার হাতে নিহত রূপলাল দাস ও প্রদীপ দাসের কথা বলা যায়। নিরীহ এই দুজন মানুষের ওপর যখন মব-জনতা হামলে পড়ে ঘটনাস্থলেই ছিল পুলিশ। মবের হাত থেকে আক্রান্ত মানুষ দুটিকে উদ্ধারের পরিবর্তে ঘটনাস্থল আতঙ্কে পালিয়ে যায় পুলিশ এবং প্রায় এক ঘণ্টা পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় ফিরে আসে, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই ঘটনা স্পষ্ট করে দিয়েছে—আমাদের জননিরাপত্তা কতটা নড়বড়ে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা ভীত ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এ ঘটনাটি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমেও জায়গা করে নেয়, যা মবের ভয়াবহতা বিশ্বদৃষ্টিতে তুলে ধরে।
কুমিল্লার মুরাদনগরে তিন সদস্যের একটি পরিবারকে হত্যা, লালমনিরহাটে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ছিনিয়ে নিতে থানায় হামলা, কিংবা সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনাও আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বাংলাদেশে আজ আইন আর বিচার জনতার হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও হয়ে উঠছে অস্থির ভিড়-চালিত সহিংসতার ক্ষেত্র, যেখানে যুক্তি ও সংলাপকে আড়াল করছে গর্জনরত জনতা।
মব ভায়োলেন্সের পেছনে একাধিক জটিল কারণ কাজ করছে। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থার চরম পতন। বিগত ১৫ বছরের স্বৈরশাসন, দীর্ঘ রাজনৈতিক সহিংসতা, দোষীদের বিচারহীনতা এবং পুলিশ, আদালত ও প্রশাসনের দলীয়করণ বা আওয়ামীকরণ এই আস্থাহীনতাকে আরও গভীর করেছে। ফলে নাগরিকেরা প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়বিচারের পরিবর্তে তাৎক্ষণিক প্রতিশোধের পথ বেছে নিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর সবচেয়ে দ্রুত মাধ্যম হয়ে উঠেছে। একটি ভুয়া ভিডিও বা বিকৃত খবর মুহূর্তেই জনতাকে উত্তেজিত করে সহিংসতায় নামিয়ে আনতে পারে, যার লক্ষ্য হয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা সমাজের দুর্বল অংশ।
এছাড়া রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়ও গুরুতর। ক্রমবর্ধমান মেরুকৃত রাজনীতিতে অনেক সময় নেতারা জনতাকে উসকে দিয়ে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর হাতিয়ার বানিয়েছেন। স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মব কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে; আবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিকেও কিছু সহিংস ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে নিন্দা জানালেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি; বরং নীরবতা, অস্বীকার বা বাছাই করে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, যা কার্যত এই সহিংস সংস্কৃতিকে আরও প্রলম্বিত করেছে।
এখানে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে পুলিশ বাহিনীর অকার্যকারিতা ও ভীরুতা। বহু ঘটনায় পুলিশ উপস্থিত থেকেও ভিড় ঠেকাতে সাহস দেখাতে পারেনি। একদিকে জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকা, অন্যদিকে আন্দোলন-পরবর্তী প্রতিশোধমূলক সহিংসতায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে হামলা—সব মিলিয়ে বাহিনীটি আজও ভীতসন্ত্রস্ত। সরকারের নীরবতা এবং অপরাধীদের দমন করতে ব্যর্থতা জনতার হাতে মব জাস্টিস প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতিকে আরও গভীরভাবে প্রোথিত করেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, মব ভায়োলেন্স মোকাবিলায় তাদের সাফল্য প্রায় শূন্য। বারবার ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং স্পষ্ট হয়েছে যে, পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই নির্বিচারে পুলিশি শক্তি প্রয়োগ, গ্রেপ্তার এবং মিথ্যা মামলা-হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে গুরুতর আহত করার ঘটনা, কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন জোবরা গ্রামে সংঘর্ষের সময় নীরব থাকা—সবই দেখায় যে এই সরকার ন্যায়বিচার রক্ষার পরিবর্তে দমননীতির পথেই হাঁটছে। ফলে দেশের নাগরিকরা আজ কার্যকর উদ্যোগের জন্য মরিয়া, আর জনতার সহিংসতা নিয়ে গভীর শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে।
নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে রাষ্ট্রের সবচেয়ে জরুরি কাজ ছিল পুলিশ বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে পুনর্গঠন করা। পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা হলে তবেই এই বাহিনী জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে। রাষ্ট্রের উচিত বিশেষ প্রশিক্ষিত ও সজ্জিত ইউনিট গড়ে তোলা, যারা দ্রুত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। প্রতিটি ঘটনায় স্বচ্ছ তদন্ত, অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যে গণহিংসা একটি গুরুতর অপরাধ এবং এটি কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। বিচার বিভাগ ও পুলিশকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে, যাতে তারা নিরপেক্ষভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারে। দমনমূলক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ ও সংলাপই হওয়া উচিত সরকারের অগ্রাধিকার।
বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে। সামনে দুটি পথ খোলা: হয় আমরা মব জাস্টিসের দিকে আরও এগিয়ে যাব, যেখানে রাষ্ট্র ধসে পড়ে সোমালিয়া বা লিবিয়ার মতো অরাজকতায় নিমজ্জিত হবে; নয়তো আমরা দৃঢ় রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব, শিক্ষার বিস্তার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সামাজিক পুনর্মিলনের মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ পুনর্গঠন করব। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুরে শক্তিশালী প্রশাসন ও আইনের শাসনের কারণে জনতার সহিংসতা নিয়ন্ত্রিত রয়েছে। রুয়ান্ডা ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পর ধ্বংসপ্রায় হলেও, রাজনৈতিক পুনর্গঠন, আইনের শাসন এবং জাতীয় একতা স্থাপনের মাধ্যমে দেশটি স্থিতিশীল ও উন্নত হয়েছে। সিয়েরা লিওনে দীর্ঘ সময়ের গৃহযুদ্ধের পর ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের মতো কার্যকর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজ পুনর্গঠন সম্ভব হয়েছে। এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে জনতার সহিংসতার সংস্কৃতি ভেঙে ফেলা সম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কোন পথ বেছে নেব?
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলিমরা নিগৃহীত হয়েছিল। বাংলাদেশও সেই সহিংসতা থেকে রেহাই পায়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুরা নিগৃহীত হয় সেবার। কিন্তু ওই দাঙ্গার দাগ পশ্চিমবঙ্গে লাগেনি। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমাদের সরকার দাঙ্গা চায়নি তাই হয়নি। সরকার না চাইলে কোথাও দাঙ্গা হতে পারে না।”
জ্যোতি বসুর বক্তব্যটা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে খুঁজে পাইনি। তবে সেবার পশ্চিমবঙ্গে যে কোনো দাঙ্গা হয়নি, এই তথ্যটা সঠিক এবং এটাও সত্য যে কোনো ধরনের দঙ্গলবাজি বন্ধ করার দায়িত্ব আসলে সর্বাগ্রে সরকারের ওপরই বর্তায়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি মব সন্ত্রাস বন্ধ করার দায় শুধু সরকারের নয়, প্রতিটি নাগরিকেরও। আমাদের সবাইকে মিলে ন্যায়, বিচার ও মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, যাতে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে আইনের শাসনের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে, ভয়ের নয়।
সূত্র: বিডি নিউজ