মব-তাড়ানো বংশীবাদকের অপেক্ষায়

সালেহ উদ্দিন আহমদ
  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:১৪

শুরু করছি নুরুল হক নুরের কথা দিয়ে। তাকে আমি আলাদাভাবে কদর করি। সেটা তার দলের আদর্শ বা এজেন্ডার জন্য নয়—ওইসব আমার তেমন জানা নেই। এর বাইরের দুইটা কারণে তাকে আমার পছন্দ। প্রথমত, ডাকসু—তিনি ডাকসুর ভিপি ছিলেন, আর অনেক বছর আগে, মুক্তিযুদ্ধপূর্বকালে আমিও ডাকসুর একজন সম্পাদক ছিলাম। দ্বিতীয় কারণটি হলো তার কোটা আন্দোলন। ভিপি থাকা অবস্থায় তিনিই প্রথম হাসিনাকে পর্যদুস্ত করেছিলেন কোটা আন্দোলন করে। তখনকার রাজনীতি যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন, তারা জানেন—ওই সময় তার অনেক সুযোগ ছিল ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার কিংবা শেখ হাসিনার পারিষদবর্গের একজন হয়ে যাওয়ার। কিন্তু তিনি সেই সবকিছু এড়িয়ে নিজের মতোই পথ চলেছেন। এই জন্য তাকে কম অত্যাচারিত হতে হয়নি। ছাত্রলীগ-যুবলীগের পাণ্ডারা তাকে যেখানে পেত, সেখানেই পিটাতো।
এটা বলা অতুক্তি হবে না—জুলাই আন্দোলনের ভিত্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নুরুল হক নুরুই গড়ে তুলেছিলেন, প্রকাশ্যে । আন্দোলন সফল হওয়ার পর নুরুর নাম কাউকে স্মরণ করতে দেখিনি, নতুন নতুন নাম বের হয়ে আসতে থাকল মূলত গুপ্ত রাজনীতি থেকে। নেতৃত্বদানকারীদের মধ্য থেকে প্রকাশ্য যে নামগুলো এসেছে, তাদের বেশির ভাগই একসময় নুরের ছাত্র সংগঠন দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি নিয়েছিলেন।
দলীয় রাজনীতি করতেও তাকে যথেষ্ট প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, কারণ তার পরিবারের উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি কোনো ‘নেইমব্র্যান্ড’ দল পাননি; সবকিছু তাকে শুরু করতে হয়েছে ধুলো থেকে। জাতীয় পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করার সংগ্রামে তিনি যেভাবে আহত হয়েছেন, তার জন্য আমি খুব ব্যথিত। ব্যথিত দুই কারণে—(১) তার শারীরিক আঘাতের জন্য, (২) তার এই এজেন্ডাটা আমি মেনে নিতে পারছি না। নুরের মতো একজন তরুণ নেতা মৃত শেয়ালকে মারতে গিয়ে আহত হবেন কেন?
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাও একই কথা বলেছেন, “জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের বিষয়ে নুরের দলের কর্মসূচি যথার্থ ছিল না।” তিনি বিবৃতি দিতে পারতেন, তিনি কোর্টে মামলা করতে পারতেন, তিনি সংবাদ সম্মেলন করতে পারতেন। কিন্তু তার মতো নেতা মব করবে কেন? তাও একটি তুচ্ছ কারণে!
১২ জুন নুরুল হক নুর তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে দেওয়া একটি পোস্টে অভিযোগ করেন, তার নিজ এলাকা পটুয়াখালীর গলাচিপায় বিএনপির নেতাকর্মীরা তাকে ও তার অনুসারীদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। পরে সেনাবাহিনী গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। তিনি যদি বিএনপির লোকদের প্রতিহত করতে পাল্টা মব করতেন, আমি বলতাম আত্মরক্ষা। যদিও মব ভায়োলেন্স বিষয়টাই আমার অপছন্দ। নুর যদি সিলেটে সাদা পাথর চুরি প্রতিরোধ করতে গিয়ে আহত হতেন, আমি তাকে বাহবা দিতাম। কিন্তু জাতীয় পার্টি নিয়ে অযথা হুলস্থূল করে নুরের আহত হওয়াটা আমি মেনে নিতে পারছি না।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, নুর সবসময় অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছেন। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না গেলে লাভ হবে কার জামায়াত ইসলামী ও এনসিপির; এই দুটি যদি নির্বাচনে আসে, তাহলে লাভবান হবে বিএনপি। রংপুরের সিটগুলো তাদের পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। নুর বা নূরের দলের লাভ কী? নুরকে যারা তাকে তার নিজ এলাকায় অবরুদ্ধ করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়, তারা অবশ্যই তার শুভার্থী নয়। রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের কাজের পরিধি যাচাই-বাছাই করে নির্ধারণ করতে হবে এবং নিজের মত জোর করে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে দূরে থাকতে হবে। আমি অতি দ্রুত নূরের সুস্থতা কামনা করছি।
মবের ভয়ে সারা দেশ থরথর করে কাঁপছে। যারা আমাদের সরকারের দায়িত্বে আছেন, তারাও এর থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। এনসিপি যমুনা ঘেরাও করে রাতারাতি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কাগজ বের করে নিল, কোনো কোর্টের রায়ের তোয়াক্কা করল না। নূরের দল ৪৮ ঘণ্টার নোটিশ দিয়েছে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে; অ্যাটর্নি জেনারেল নড়েচড়ে উঠেছেন। ফলাফল সহসা জানা যাবে।
আইন উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বারবার বলে আসছেন — মামলা ছাড়া গ্রেফতার নয় এবং মামলা করলেই গ্রেফতার নয় প্রমাণ ছাড়া। তারা তাদের এই দুটি কথার একটাও রাখতে পারছেন না, মবকারীদের চাপে বা ভয়ে।
সর্বশেষ, ‘জুলাইয়ের যোদ্ধা’ পরিচয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একদল লোককে অবরুদ্ধ করে মব ভায়োলেন্স করা হয়েছে, আক্রান্তদের মধ্যে রাজনীতিবিদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সবাই হেনস্তার শিকার হয়েছেন। পুলিশ 'জুলাই যোদ্ধাদের' ‘আদেশ’ অনুসরণ করে আক্রান্তদের ধরে থানায় নিয়ে গিয়ে মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে। পুলিশও হিমশিম খেয়েছে—কী মামলা লিখবে! পরে ওই ‘জুলাইয়ের যোদ্ধা’দের পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। তাদের নেতা, আমিরে জামায়াত, কতবার যে বলেছেন—তিনি নাকি মবের বিরুদ্ধে!
নেতারা মবের বিরুদ্ধে, উপদেষ্টারাও মবের বিরুদ্ধে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বলেছেন—‘অভ্যুত্থানের পক্ষে হলেও মব করা বন্ধ করুন। আর যদি মব করেন, তাহলে আপনাদেরও ডেভিল (শয়তান) হিসেবে ট্রিট (গণ্য) করা হবে।’ কিন্তু এখনো মবকারীরা মব করেই বেড়াচ্ছে বিভিন্ন নামে—আর সরকার নানা উপায়ে তাদের তোষণ করছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচার শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন করতে দেবে না এনসিপি। অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, এজন্য তাদের তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে—‘ফলে যতটা নিখুঁতভাবে এই কাজটা করা দরকার ছিল, তা কিন্তু আমি হয়তো করতে পারব না। অনেক বেশি রাশ (তাড়াহুড়া) করতে হচ্ছে।’ এটাও এক ধরনের মবতাড়িত সিদ্ধান্ত হয়ে যেতে পারে।
শিক্ষার্থীদের জুলাই আন্দোলনে অংশ নিলে ছাত্রত্ব বাতিলের ‘হুমকির অডিও’ ফাঁসের পর রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রক্টর এ জে এম নুর-ই-আলমকে সব ধরনের কার্যক্রম থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কারাদেশের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বহিষ্কৃত শিক্ষক এ জে এম নুর-ই-আলম। তিনি বলেছেন, ‘তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি।’ এ ব্যাপারে উপাচার্য বলছেন, ‘মবের জন্যই তাড়াহুড়া করেছি।’ হায়রে, এখানেও মবের ভয়!
আমাদের জাতীয় জীবনের এমন কোনো ক্রিয়াকর্ম নেই, যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই মবের ভয়ে তটস্থ না থাকেন। কিছু মব ভায়োলেন্সকারী আমাদের পুরো জাতিটাকে জিম্মি করে রেখেছে। আমাদের যারা রাজা, তারা এদের ভয়ে তটস্থ। রাজনীতিবিদ যারা সামনে রাজা হবেন, তারাও নিজেদের সুযোগ-সুবিধার জন্য এদের সঙ্গে তাল মিলাচ্ছেন। আর যারা মব বাহিনী, তারা দেশটাকে দিন দিন নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা যারা প্রজা, তারা এই মবকারীদের কাছে ক্ষমতাহীন—চোখ বুজে সব মেনে নিচ্ছি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার, আইন-আদালত কোথাও ভরসার জায়গা নেই। আমাদের এখন একজন হ্যামিলনের বংশীবাদকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর কত দিন তার অপেক্ষায় থাকতে হবে, যে আমাদের শহর ও গ্রামগুলো থেকে শিশুদের নয়, ইঁদুর তাড়ানোর মতো মব ভায়োলেন্সকারীদের বাঁশির সুরে ডেকে নিয়ে ভাসিয়ে দেবে দূরের সমুদ্রে।
সূত্র: বিডি নিউজ২৪.কম