বৈশাখের এক পড়ন্ত বিকাল। টেবিলে বসে কিছু একটা খুঁজছিলাম। হঠাৎ একটা পুরোনো টিনের কৌটার ঢাকনার নিচে চোখে পড়ল ছোট্ট একটা কালো ঘড়ি। ডিজিটাল স্ক্রিনে এখন আর কোনো আলো নেই, কিন্তু তার রাবারের ব্যান্ডটা যেন এখনো আগের মতোই শক্ত।
চোখের পলকে ফিরে গেলাম সেই স্কুলজীবনের দিনে। কে কিনে দিয়েছিল মনে করতে পারি না, তবে আমি এই এফ-৯১ডব্লিউ মডেলের ঘড়ির চেয়ে তার প্যাকেটটাই বেশি সময় ধরে দেখেছিলাম। ক্যাসিওর নীল রঙা লোগোটা যেন তখনই হৃদয়ে গেঁথে যায়।
তখন মনে হতো, হাতে ঘড়ি মানেই বড় হয়ে গেছি। স্কুল ড্রেসের পাশে এই ডিজিটাল ঘড়ি ছিল সবচেয়ে দামি সাজ। আর ক্যাসিও? সে তো ছিল ‘হাতের রাজা’। পরীক্ষার হলে অ্যালার্ম সেট করে রাখা, টিফিন পিরিয়ড গুনে সময় দেখা, এমনকি ক্লাসে বসে বোতামের শব্দে বন্ধুর মনোযোগ কাড়াও ছিল ক্যাসিও ঘড়ির অন্যতম চমক।
১৯৭৪ সালে জাপানের এই ব্র্যান্ডটি প্রথম ডিজিটাল ঘড়ি ‘ক্যাসিওট্রোন’ বাজারে আনে। সময় বলার পাশাপাশি মাসের তারিখ, সপ্তাহের দিন সবকিছুই বলত এই ছোট্ট ঘড়ি। এরপর একে একে আসে ক্যালকুলেটর ঘড়ি, ওয়ার্ল্ড টাইম, স্টপওয়াচ ফিচারসহ অসংখ্য মডেল। প্রযুক্তি আর টেকসইতার এই মিশেল ক্যাসিওকে বানিয়ে দেয় ভরসার নাম।
নব্বইয়ের দশক কিংবা ২০০০ সালের শুরুর দিকের কিশোরদের হাতে একটি ক্যাসিও ঘড়ি মানেই ছিল আত্মবিশ্বাস। বন্ধু কিংবা প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করার ঠিক আগে ঘড়িতে চোখ রাখত তখনকার মানুষ আর ভাবতো ‘সে তো এখনই আসবে’। ঘড়ি তখন শুধু সময় নয়, একজন নিরব সাক্ষী।
বর্তমানে হাতে ঘড়ি মানেই যেন স্মার্টওয়াচ। কল ধরার সুবিধা থেকে শুরু করে হার্টবিট মাপা সবই এখন ঘড়ির এক ছোঁয়ায় সম্ভব। বাজারে অ্যাপল, স্যামসাং, হুয়াওয়ের মতো ব্র্যান্ডের আধিপত্য। সেই তুলনায় পুরোনো সেই ডিজিটাল ঘড়ি, বিশেষ করে ক্যাসিওর সেই নির্ভরযোগ্য মডেল আজ আর খুব একটা চোখে পড়ে না। দোকানে গেলেও এখন আর কেউ বলে না, ‘ভাই, একটা ক্যাসিও দেখাই।’
ভাঙা ঘড়িটার দিকে তাকালে টিকটিক শব্দ পাই না ঠিকই, কিন্তু মনে হয় স্কুলব্যাগ কাঁধে ফেলে, বন্ধুদের সঙ্গে বিকালে মাঠে ছুটছি। সময় থেমে থাকেনি, কিন্তু ক্যাসিও যেন একজায়গায় থেমে থাকা অনুভূতির নাম।
আমাদের জীবনে এমন কিছু বস্তু থাকে, যেগুলো প্রযুক্তির অংশ হলেও আসলে হৃদয়ের অনুভব। ক্যাসিও ঘড়ি তেমনই এক ভালোবাসা, এক নস্টালজিয়া। যা আমরা সময়ের সঙ্গে হারাতে পারি না, শুধু লুকিয়ে রাখি পুরোনো ড্রয়ারের গহীনে।