দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ যখন পতনের দ্বারপ্রান্তে, তখন 'অপরাজেয়' এক শক্তি হয়ে এগিয়ে এসেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। জোসেফ স্ট্যালিনের রেড আর্মির বিজয় শুধু একটি সামরিক সাফল্য ছিল না, এটি ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অন্ধকার এক শক্তির পরাজয়। বার্লিনে জার্মান পার্লামেন্টের (রাইখস্টাগ) উপর উড়ন্ত সোভিয়েত পতাকা এবং নাৎসিদের আত্মসমর্পণ ছিল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা ইউরোপ তথা বিশ্বকে শান্তি ও স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়েছিল।
আজ ৯ মে'র এই বিজয় দিবসে রাশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। দিনটি রাশিয়ার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় মাইলফলক, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈনিকরা নাৎসি জার্মানির আগ্রাসনকে পরাজিত করে ইউরোপকে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত করেছিল।
এই প্রতিবেদনে আমরা সেই ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম তুলে ধরব—কীভাবে সোভিয়েত বাহিনী নাৎসি জার্মানিকে পরাজিত করেছিল, কীভাবে বার্লিনে জার্মান পার্লামেন্ট (রাইখস্টাগ) দখল করেছিল, পতাকা উত্তোলন করেছিল এবং কীভাবে জার্মানি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
পটভূমি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও সোভিয়েত ফ্রন্ট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের 'পূর্ব ফ্রন্ট' ছিল যুদ্ধের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন। ১৯৪১ সালের ২২ জুন নাৎসি জার্মানি 'অপারেশন বারবারোসা'র মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ চালায়। জার্মান বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হয়ে সোভিয়েত অঞ্চলের বিরাট অংশ দখল করে। তবে সোভিয়েত জনগণ ও রেড আর্মির 'লৌহ প্রতিরোধ' এই আগ্রাসনের গতি রোধ করে।
মস্কোর যুদ্ধ (১৯৪১-৪২) এবং স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধ (১৯৪২-৪৩) ছিল যুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট। স্টালিনগ্রাদে জার্মান সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলে সোভিয়েত বাহিনী তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এই বিজয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণাত্মক অবস্থানে নিয়ে যায় এবং জার্মান বাহিনীকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে।
বার্লিনের পতন: রাইখস্টাগ দখল
১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে সোভিয়েত বাহিনী বার্লিনের দিকে অগ্রসর হয়। রেড আর্মির হাতে তুলোধুনো হয়ে এই সময়ে নাৎসি জার্মানি প্রায় ধ্বংসের মুখে ছিল। এডলফ হিটলার বার্লিনে অবস্থান করে শেষ প্রতিরোধের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তবে সোভিয়েত মার্শাল গিওর্গি ঝুকভের নেতৃত্বে 'প্রথম বেলারুশিয়ান ফ্রন্ট' এবং মার্শাল ইভান কোনেভের নেতৃত্বে 'প্রথম ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট' বার্লিনকে ঘিরে ফেলে।
১৬ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া বার্লিনের যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনী প্রায় ২০ লাখ সৈন্য, ৬,০০০ ট্যাঙ্ক এবং ৪০,০০০ আর্টিলারি নিয়ে জার্মান প্রতিরক্ষা ভেঙে ফেলে। ১৫ দিনের মাথায় ৩০ এপ্রিল হিটলার বার্লিনে তার বাঙ্কারে আত্মহত্যা করেন, যা নাৎসি প্রতিরোধের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়।
রাইখস্টাগ, জার্মান পার্লামেন্ট ভবন; এটি ছিল নাৎসি শাসনের প্রতীক। ৩০ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত সোভিয়েত সৈন্যরা রাইখস্টাগের নিয়ন্ত্রণ নিতে তীব্র লড়াই করে। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল রাতে সোভিয়েত সৈনিক মিখাইল ইয়েগোরভ এবং মেলিটন কান্তারিয়া রাইখস্টাগের ছাদে সোভিয়েত পতাকা উত্তোলন করেন।
এই ঘটনা 'বিজয়ের প্রতীক' হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়। ফটোগ্রাফার ইয়েভগেনি খালদেই-এর তোলা 'রাইখস্টাগের উপর বিজয় পতাকা' ছবিটি ইতিহাসের একটি অমর দলিল হয়ে ওঠে।
জার্মানির আত্মসমর্পণ
রাইখস্টাগ দখলের পর জার্মান প্রতিরোধ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। ২ মে ১৯৪৫-এ বার্লিনের জার্মান গ্যারিসন আত্মসমর্পণ করে। তবে নাৎসি জার্মানির চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ ঘটে ৮ মে ১৯৪৫-এ। সেদিন রাতে জার্মান হাইকমান্ডের প্রতিনিধি ফিল্ড মার্শাল উইলহেলম কাইটেল বার্লিনের কার্লশর্স্টে সোভিয়েত মার্শাল ঝুকভ এবং মিত্র বাহিনীর প্রতিনিধিদের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন। এই দলিলে জার্মান বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ঘোষণা করা হয়।
মস্কোর সময় অনুযায়ী, আত্মসমর্পণ কার্যকর হয় ৯ মে, যে কারণে রাশিয়া এই দিনটিকে বিজয় দিবস হিসেবে উদযাপন করে। পশ্চিমা দেশগুলো ৮ মে দিনটিকে VE Day (Victory in Europe Day) হিসেবে পালন করে।
বিজয়ের তাৎপর্য
সোভিয়েত ইউনিয়নের এই বিজয় এসেছিল অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ কোটি সোভিয়েত নাগরিক ও সৈনিক এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল। স্টালিনগ্রাদ, লেনিনগ্রাদ, কুর্স্ক এবং বার্লিনের যুদ্ধে সোভিয়েত জনগণের অদম্য সাহস ও দৃঢ়তা ফ্যাসিবাদের পরাজয় নিশ্চিত করেছিল।
রাশিয়া আজ এই বিজয়কে মস্কোর রেড স্কয়ারে স্মরণ করছে বর্ণাঢ্য সামরিক কুচকাওয়াজ, ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার বার্ষিক ভাষণে বলেছে, 'এই বিজয় আমাদের পূর্বপুরুষদের সাহস ও ঐক্যের প্রতীক। আমরা তাদের ত্যাগের কাছে চিরঋণী।'