পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুর—দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলঘেঁষা এ তিন জেলার পরিচিতি ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগের অঞ্চল হিসেবে। তবে গত কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলের আরেকটি পরিচিতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে দেশের বাজারে। তা হলো তালের পাটালি গুড়।
তালের রস থেকে তৈরি এ গুড় একদিকে যেমন স্বাদে অতুলনীয়; তেমনই দামে অন্য গুড়ের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ গুড়। উৎপাদন স্থান থেকে পাইকারি কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৮০ টাকায়।
তালের গাছ থেকে সংগৃহীত রস কয়েক ঘণ্টা চুলায় জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় এ গুড়। এতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল বা সংরক্ষক মেশানো হয় না। বরং এটি সম্পূর্ণভাবে নির্ভেজাল এবং স্বাস্থ্যসম্মত এক প্রাকৃতিক মিষ্টান্ন।
বরগুনার আমতলী উপজেলার গুড় প্রস্তুতকারক মো. শামসুল হক বলেন, ‘ভোরে গাছে উঠে রস নামাই। সকালবেলা চুলায় জ্বাল দিয়ে দুপুর নাগাদ গুড় তৈরি হয়। এতে কোনো ভেজাল দেওয়া হয় না। তাই স্বাদটা অন্য সব গুড়ের চেয়ে আলাদা।’
এ গুড়ের স্বাদে যে একধরনের মাটির ঘ্রাণ মিশে আছে, তা বললে ভুল হবে না। অনেকেই বলেন, মুখে দিলেই যেন মলিন হয়ে যাওয়া শৈশবের স্বাদ ফিরে আসে।
ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের বাজারে সাধারণত আখের গুড় কিংবা কৃত্রিম চিনির বিকল্প হিসেবে মিশ্রিত গুড় পাওয়া যায়। কিন্তু তালের পাটালি গুড় নরম, চকচকে এবং স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় শহরের ভোক্তাদের কাছে এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার গৃহিণী সেলিনা রহমান বলেন, ‘এই গুড় আমি গ্রামের বাড়ি থেকে আনাই। বাজারের গুড়ের মতো এতে কোনো ঝাঁঝালো গন্ধ নেই। পায়েস, পিঠা, এমনকি দুধের সাথেও মিশিয়ে খেতে চমৎকার লাগে।’
তবে সম্ভাবনার বিপরীতে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। গুড় প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, শ্রমিক সংকট এবং আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার অভাবে এ গুড় এখনো বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন ও বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে না।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কৃষক আজিজুল হক বলেন, ‘সরকার যদি আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ এবং সংরক্ষণের জন্য সহায়তা দিতো, তাহলে আমরা অনেক বেশি গুড় উৎপাদন করতে পারতাম। দেশের বাইরেও এ গুড় পাঠানো যেত।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ গুড় শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বিদেশের বাজারেও সম্ভাবনাময় একটি কৃষিপণ্য হতে পারে। কিন্তু এর জন্য দরকার প্যাকেজিং, মান নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।’
পিরোজপুর চেম্বার অব কমার্স জানায়, তালের পাটালি গুড় যদি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তাহলে এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ গুড় প্রবাসীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। তারা দেশ থেকে সরাসরি নিয়ে যান।
তালের পাটালি গুড় শুধু একটি খাদ্যপণ্য নয়। এটি বাংলার গ্রামীণ জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ গুড়ের ঘ্রাণে লেগে আছে শেকড়ের টান, ঐতিহ্যের ছোঁয়া। সঠিক পরিকল্পনা, সংরক্ষণ ও বিপণন কৌশলের মাধ্যমে এটি হতে পারে উপকূলীয় অর্থনীতির মিষ্টি ভবিষ্যৎ।