মহাবিশ্বের বিশালতা সবসময়ই মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। তারা, গ্যালাক্সি, নীহারিকা—এসব দৃশ্যমান বস্তু বা পদার্থের পাশাপাশি মহাবিশ্বে এমন 'অদৃশ্য কিছু' রয়েছে, যা বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার কারণ। এসব অদৃশ্য বিষয়গুলোই মূলক ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি।
দৃষ্টিজগতের বাইরে মহাবিশ্বের সম্পূর্ণ গঠনের প্রায় ৯৫ শতাংশই এই ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি। অথচ আমরা এদের সম্পর্কে খুব কমই জানি। এরাই মহাবিশ্বের গঠন ও বিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি।
বিজ্ঞানের রহস্য উদঘাটনের প্রচেষ্টা আমাদের মহাজাগতিক অস্তিত্ব সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিচ্ছে। ভবিষ্যতের গবেষণা হয়তো এই অদৃশ্য শক্তির পর্দা উন্মোচন করবে, আর আমরা জানতে পারবো মহাবিশ্বের প্রকৃত গল্প। তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে - সেসব তথ্য থেকে জানা যাক ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি আসলে কী? এদের কাজ কী?
বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত যা জেনেছেন, ডার্ক ম্যাটার এমন একটি উপাদান, যা আলো শোষণ বা নির্গত করে না। তাই সরাসরি দেখা যায় না। বিজ্ঞানীরা এর অস্তিত্ব বুঝতে পেরেছেন এর মহাকর্ষীয় প্রভাবের মাধ্যমে। মহাবিশ্বের প্রায় ২৭ শতাংশ গঠিত এই ডার্ক ম্যাটার দিয়ে।
কাজ কী?
ডার্ক ম্যাটার গ্যালাক্সিগুলোকে একত্রে ধরে রাখে। এটি একটি অদৃশ্য কাঠামো তৈরি করে, যার উপর সাধারণ বস্তু (তারা, গ্রহ ইত্যাদি) গঠিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, গ্যালাক্সির ঘূর্ণন গতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, দৃশ্যমান বস্তুর মহাকর্ষ শক্তি গ্যালাক্সিগুলোর গতির ব্যালেন্স বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ডার্ক ম্যাটারের অতিরিক্ত মহাকর্ষই এই ভারসাম্য রক্ষা করে। এছাড়া, মহাবিশ্বের বৃহৎ কাঠামো (গ্যালাক্সি ক্লাস্টার) গঠনেও এটি গুরুত্বপূর্ণ।
বিস্তার কেমন?
ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বে অসমভাবে ছড়িয়ে আছে। গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের চারপাশে এটি একটি ‘হ্যালো’ বা বলয়ের মতো গঠন তৈরি করে, কিন্তু দেখা যায় না। এটি কোনো নির্দিষ্ট গ্রহ বা তারার মতো স্থানীয়ভাবে কেন্দ্রীভূত নয়।
এটি কী দিয়ে তৈরি?
এটি এখনো রহস্য। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, ডার্ক ম্যাটার হয়তো কিছু 'অজানা কণা' দিয়ে তৈরি। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগারে এই 'কণা' শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
ডার্ক এনার্জি: 'মহাবিশ্বের ত্বরণের কারণ'
ডার্ক এনার্জি বিষয়টি ডার্ক ম্যাটারের চেয়েও রহস্যময়। এটি মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮ শতাংশ গঠন করে আছে এবং এটিকে মহাবিশ্বের 'ত্বরিত বিস্তারের' জন্য দায়ী মনে করা হয়।
১৯৯০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, মহাবিশ্ব শুধু বিস্তার করছে না, বরং এর গতি ক্রমশ বাড়ছে। এই ত্বরণ ব্যাখ্যা করতেই ডার্ক এনার্জির ধারণা আসে।
কাজ কী?
ডার্ক এনার্জি একটি প্রতিবিষয়ক শক্তি (repulsive force) হিসেবে কাজ করে, যা মহাকর্ষের বিপরীতে গিয়ে বস্তুগুলোকে একে অপর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এটি মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোকে আরও দ্রুত ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বিস্তার কেমন?
ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বে সর্বত্র সমানভাবে বিস্তৃত। এটি কোনো নির্দিষ্ট স্থানে কেন্দ্রীভূত নয়, বরং মহাবিশ্বের প্রতিটি কোণে এর উপস্থিতি রয়েছে। এটি 'শূন্যতার শক্তি' (vacuum energy) বা 'কোয়ান্টাম ফিল্ডের' কোনো রূপ হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
চ্যালেঞ্জ ও গবেষণা
ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন টেলিস্কোপ (যেমন হাবল, জেমস ওয়েব) ও পরীক্ষাগারে এদের প্রকৃতি উদঘাটনের চেষ্টা করছেন। ইউক্লিড স্পেস টেলিস্কোপ, লার্জ সিনপটিক সার্ভে টেলিস্কোপ (LSST) এবং ডার্ক এনার্জি সার্ভের মতো প্রকল্পগুলো এই রহস্য সমাধানে কাজ করছে।