মাইলস্টোনের দুর্বিষহ সেই স্মৃতি ভুলতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০২ আগস্ট ২০২৫, ১২:৪৪

প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা মেলে সবুজ-ছায়া ঘেরা সু-বিশাল খেলার মাঠ। কর্মব্যস্ত দিনে যেখানে শিক্ষার্থীদের পদচারণায়-মাঠটি মুখর থাকার কথা সেখানে নেই কোনও হৈ-হুল্লোড়। নেই দিগ্বিদিক ছোটাছুটি। বাতাসে ভেসে আসছে না শিশুদের কল্লোল। মাঠের পাশে রাস্তা ঘেঁষে অবস্থিত রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিধ্বস্ত ভবনটি থেকে এখনও আসছে পোড়া গন্ধ।
মাইলস্টোনে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনার পর ১৩ দিন পেরিয়ে গেলও এখনও ভয়ে-আতঙ্কে শিউরে উঠছে শিক্ষার্থীরা। তাদের সামনে ভাসছে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি। কাছের বন্ধুদের চিরদিনের জন্য হারিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকে বাকহীন। অসুস্থতা আর অস্বাভাবিক আচরণে দিন কাটাচ্ছে অনেকে। শিক্ষার্থীদের এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আনতে ইতোমধ্যে সেখানে বিশেষ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চলছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী দ্বারা পরিচালিত সাত দিনব্যাপী অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প। ওই ক্যাম্পে শিক্ষার্থীদের সেবা দিতে চিকিৎসকদের পাশাপাশি মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। বিমানবাহিনী ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করতে বুথ বসিয়েছে কিছু বেসরকারি সংস্থাও।
ওই ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, কাউন্সেলিং সেন্টারের সামনে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবক ও স্বজনদের নিয়ে অপেক্ষা করছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের একেক জনকে ঘণ্টাব্যাপী কাউন্সেলিং করতে দেখা গেছে।

বন্ধুদের চিরদিনের জন্য হারিয়ে অনেকে বাকহীন
দুর্ঘটনার পর থেকে মানসিক অস্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছে ওই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থী তামজিদুল ইসলাম মাসরুর (১০)। তার মা নিলুফা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঘটনার দিন আগেই স্কুল ছুটি হয়ে যায়। আমি যখন ছেলেকে নিয়ে স্কুল গেট থেকে বের হলাম, তখনই বিমানটা পড়লো। বের হওয়ার কারণে আমরা বেঁচে গেছি। মাসরুর তার বন্ধু আরিয়ানকে হারিয়েছে। এসব ভেবে সে এখন ভয় পাই। ফোন হাতে নিলেই সে অস্বস্তি বোধ করে। তাই আজ তাকে কাউন্সেলিং সেন্টারে নিয়ে আসলাম। তাকে কাউন্সেলিং করা হয়েছে। ধীরে ধীরে যদি তার ট্রমা কাটে, এখন সেটাই ভাবছি।
মাসরুর মতোই এ ঘটনার পর থেকে অস্বাভাবিক আচরণ করছে প্লেতে পড়ুয়া সাড়ে চার বছরের শিক্ষার্থী সাবিয়া ইসলাম। একটু পর মাকে বলতে শোনা গেছে পাইলট আসতেছে আসতেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবিয়ার মা বলেন, সেই ঘুমাতে গেলে বলে এখন বিমান যাবে। পাইলট আসতেছে, পাইলট আসতেছে। আমরা ঘুমাতে পারি না। কারণ সে ঘুমায় না, ভয় পাই। তাই আজ কাউন্সেলিং করতে নিয়ে এলাম। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে বুঝানোর চেষ্টা করছে।
স্কুলে কাউন্সেলিং নিতে আসা অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী চৌধুরী রেজুয়ান বিন বদরুল বলেন, ঘটনার পর আজই স্কুলে আসছি। আমরা আরও পাঁচ জন বন্ধুর আসছে। আমরা একসঙ্গে বসেছি। আমরা যাদের হারিয়েছি, তাদের জন্য দোয়া করছি। আমরা যেন এখন ভালো থাকতে পারি সে জন্য ওই ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। মনে করতে চাই না।
বিধ্বস্ত ভবনের অংশ
যেভাবে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সেবা ও কাউন্সেলিং করা হচ্ছে–
সেখানে দায়িত্বরত বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ও সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সেবা দিতে আলাদা আলাদা কাউন্সেলিং বুথ বসানো হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে তাদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। যারা ছোটখাটো আঘাত পেয়েছে কিংবা যাদের ড্রেসিং প্রয়োজন তাদের ড্রেসিং করানো হচ্ছে। যেখানে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বা কাউন্সেলিং করতে আসা অনেকে প্রয়োজনে হলে সিএমএইচও পাঠানো হচ্ছে। সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি ট্রমার মধ্যে রয়েছে বা মাইন্ড ইনজুরি আছে, তাদের আলাদা বুথে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাউন্সেলিং করতে দেখা গেছে।
বিমানবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সাত দিনের অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্পে ৩১ জুলাই বেলা ২টা পর্যন্ত মোট ৬২৬ জন শিক্ষার্থীকে চিকিৎসা সেবা ও কাউন্সেলিং করা হয়। এর মধ্যে প্রথম দিন ১১৮ জন, দ্বিতীয় দিন ২০০ জন, তৃতীয় দিন ১৭২ জন এবং চতুর্থ দিনে ১৩৬ জন শিক্ষার্থীকে সেবা দেওয়া হয়েছে। আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত এই কাউন্সেলিং সেবা চলবে।
এদিকে, প্রতিষ্ঠানটির সহযোগিতায় ক্যাম্পাসে বুথ বসিয়ে জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (ব্র্যাক আইইডি)। এই কাউন্সেলিং বুথে ৩১ জুলাই বেলা ২টা পর্যন্ত ২৫০ জন শিক্ষার্থীকে সেবা  দেওয়া হয়েছে। এ বুথে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কাউন্সেলিং সেবা নিতে পারছে শিক্ষার্থীরা।
সেখানে কাউন্সেলিং করা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শাহপার নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কাউন্সেলিং নিতে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, কেউ একটু বেশি ভয় পেয়েছে, আবার কেউ কেউ একটু কম। আমরা তাদের পরিস্থিতি মাইন্ড বুঝেই কাউন্সেলিং করছি। দীর্ঘ সময় নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে। একেক জনকে একেক রকম ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে।
বুথে দায়িত্বরত ব্র্যাক আইইডির এক কর্মকর্তা জানান, তাদের কাউন্সেলিং বুথ জরুরি ভিত্তিতে চালু করা হয়েছে। যেটির সুনির্দিষ্ট কোনও সময় নেই। যখন প্রয়োজন হবে তখন বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এছাডা দুপুর ২টা দিকে সরেজমিন দেখা গেছে, মাইলস্টোন কলেজ শাখার এইচএসসি শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা শেষে করে কলেজের গাড়িতেই ক্যাম্পাসে ফিরতে দেখা গেছে। জানা গেছে ঘটনার পর পরিক্ষার্থীদের অনেকে কলেজের হোস্টেলে ফিরেছে।
এডমিন ভবনের এক কর্মকর্তা জানান, আগামী ৫ আগস্ট স্কুলের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হতে পারে। সেটি নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে এখনও নিশ্চিত নই। স্কুলের কার্যক্রম এখন শুরু হয়নি। তবে ক্লাস নাইন একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হবে আগামী ৩ তারিখ থেকে। বাকি ক্লাসগুলো বিষয়ে আলোচনা চলছে। কারণ অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখন ট্রমার মধ্যে আছে।
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজ এডমিন অফিসার ঈসমাইল হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগামী ৫ আগস্ট স্কুলের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হতে পারে। সেটি নিয়ে আলোচনা চলছে। স্কুলের কার্যক্রম এখন শুরু হয়নি। তবে নবম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শুরু হবে ৩ আগস্ট থেকে। বাকি ক্লাসগুলো বিষয়ে আলোচনা চলছে। কারণ অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা এখনও ট্রমার মধ্যে আছে।