বাঙালি কমিউনিটির বিকেন্দ্রীকরণের প্রভাব 

জ্যাকসন হাইটসে ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বিশেষ করে নিউইয়র্কে বাংলাদেশী কমিউনিটির মিলনমেলার তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাতি পায় জ্যাকসন হাইটস। প্রায় প্রতিদিনই বাঙালি কমিউনিটির লোকজন দিনের কাজ শেষে জ্যাকসন হাইটসে জড়ো হতেন আড্ডা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে অথবা নিত্য প্রয়োজনীয় বাংলাদেশী পণ্য ক্রয়ের জন্য। সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি বাঙালিসহ দক্ষিণ এশিয়ার কমিউনিটির লোকজনের পদচারণায় মুখর থাকতো জ্যাকসন হাইটস। আর এজন্য বাঙালি এবং দক্ষিণ এশিয়ার কমিউনিটির ব্যবসায়ীক প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে জ্যাকসন হাইটস। এক কথায় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীক ও সামাজিক কার্যক্রমের কেন্দ্র ছিলো জ্যাকসন হাইটস।
কমিউনিটির অনেকের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, বিগত বছরগুলো থেকে বাঙালি কমিউনিটির বিকেন্দ্রীকরণের প্রভাবে সেই জৌলুসে ভাটা পড়ছে। জ্যাকসন হাইটসের ব্যবসা বাণিজ্যেও এর প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে সিটির বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশী ব্যবসার প্রসার ঘটায় জ্যাকসন হাইটস ভিত্তিক নির্ভরতা অনেক কমেছে।
বর্তমানে সিটিতে প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি পরিবার বসবাস করছেন। দিন দিন নিউইয়র্কে বাঙালি কমিউনিটির প্রসার ঘটছে। তবে কমিউনিটির এ প্রসার শুধুমাত্র জ্যাকসন হাইটস কেন্দ্রীক থাকছেনা। নিউইয়র্ক সিটির ৫ বোরসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটে বসবাসরত বাংলাদেশীরা স্থানীয়ভাবে কমিউনিটি নির্ভর ব্যবসা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পরিচালনায় যুক্ত হচ্ছেন। এক দশক আগেও বাংলাদেশী, ভারতীয়সহ দক্ষিণ এশিয়ার সকল পণ্যের গ্রোসারী স্টোর, রেস্টুরেন্ট ছিলো শুধুমাত্র জ্যাকসন হাইটসে। বর্তমানে বাঙালি অধ্যুষিত ব্রঙ্কস, জ্যামাইকা, ব্রুকলিন, ওজনপার্কে বাংলাদেশী মালিকানাধীন অনেক গ্রোসারী ও সুপারশপ এবং রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এসব পণ্য ক্রয়ে এখন আর জ্যাকসন হাইটসে যেতে হয়না। এছাড়াও জ্যাকসন হাইটসের নিরাপত্তাসহ পারিপার্শ্বিক পরিবেশের অবনতি ঘটায় কমিউনিটির অনেকেই জ্যাকসন হাইটস বিমুখ হয়ে পড়েছেন। এজন্য ব্যবসায়ও কিছুটা মন্দাভাব সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, গত ছয়মাসে এখানকার ব্যবসা নেমে এসেছে অর্ধেকেরও নীচে । ট্রাফিক, পার্কিং সমস্যা, স্থানীয় নিরাপত্তা ঘাটতির পাশাপাশি, কমিউনিটির বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবসার এমন হাল হয়েছে। তবুও বাংলাদেশের অনুভব পেতে নিউইয়র্ক ও অন্যান্য স্টেট থেকে আসা বাঙালিরা ছুটে যান জ্যাকসন হাইটসে। কারণ জ্যাকসন হাইটসের স্ট্রিট ফুড ও রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদ অতুলনীয়।
ভার্জিনিয়া থেকে জ্যাকসন হাইটসে আসা মিস চৈতি বলেন, আমি ভার্জিনিয়াতে থাকি। নিউইয়র্কে এসেছি একটি কাজে। ভার্জিনিয়ায় বাঙালি খাবার পাওয়া যায়না তেমন। বিশেষ করে স্ট্রীট ফুড। জ্যাকসন হাইটসের ফুচকার স্বাদ অতুলনীয়। তাই আমি ও আমার বান্ধবী নিউইয়র্ক আসলে জ্যাকসন হাইটসে আসি ফুচকা ও দেশীয় খাবারের স্বাদ নিতে। এছাড়া এখানে আসলে মনে হয় আমরা ঢাকার নিউমার্কেট ও নীলক্ষেতের ভাইব পাওয়া যায়।এখানে অনেক বাঙালী কমিউনিটির আনাগোনা। এখানে আসলে পরিচিত অনেকের সাথেও দেখা মিলে। তবে আগে যেমন বাংলাদেশীদের আনাগোনা দেখা যেত। বিগত কয়েকবার ধরে এখানে আসলে সেরকম কমিউনিটির লোকজনকে তেমন দেখা যায় না। এটি কিছুটা মিস করি।
কথা হয় আরেক বাংলাদেশী কর্মজীবি নারী জোহানার সাথে। তিনি বলেন, প্রবাস জীবনে সবাই ব্যস্ত দিন পার করেন। কিন্তু উইকেন্ডে এই জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশীদের পদচারণায় মুখর থাকতো। কারণ এখানে আসলে বাংলাদেশী বন্ধু, স্বজনদের সাথে স্বাক্ষাতের সুযোগ হতো। পাশাপাশি দেশীয় সবধরণের নিত্যপণ্য পাওয়া যেতো। এছাড়াও উইকেন্ডকে ঘিরে ডাইভার্সিটি প্লাজা ও আশেপাশের রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশীদের সভা সমাবেশ, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন হতো। পরিবার পরিজন নিয়ে কমিউনিটির লোকজন সপ্তাহে অন্তত একবার আসতেন। কিন্তু এখন সেটা অনেক কমে গেছে। প্রায়ই চুরি-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। এর জন্য এখানকার নিরাপত্তা ঘাটতিও প্রভাব ফেলেছে।
জ্যাকসন হাইটসে বাজার করতে আসা প্রবীণ মো. আক্তার হোসেন বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে নিউইয়র্কে আছি। আগে কর্মব্যস্ততার পর দৈনন্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার করতে আসলে একই সাথে অনেক পরিচিতজনদের সাথে দেখা হতো আড্ডা হতো। এখন সেটি আর হয়না। কদাচিৎ কারো সাথে দেখা হয়। প্রয়োজনীয় কাজ না থাকলে আমিও এখন তেমন আসিনা। এখন কমিউনিটির লোকজন ব্রঙ্কস, জ্যামাইকাসহ সিটির বিভিন্ন স্থানে যেখানেই বসবাস করছেন সেখানেই আশেপাশে বাংলাদেশীদের বিভিন্ন সুপারশপ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেটা আগে শুধু এখানেই ছিলো। তাই কমিউনিটির লোকজন তাদের বাজার থেকে শুরু করে সব কিছু সেরে নিচ্ছেন ওইসব এলাকায় ।
ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ও বাংলাদেশ প্লাজার কর্ণধার মিনা ফারাহ বলেন, বাংলাদেশীসহ এশিয়ার কমিউনিটির কাছে বেশ সমাদৃত এই। দেশীয় নিত্যপণ্য, রেস্টুরেন্ট, জুয়েলারী স্বর্ণের দোকান ও কাপড়ের দোকানসহ সব কিছুই রয়েছে এখানে। যা নিউইয়র্কের কোন এলাকায় নেই। এখানকার কাপড় ও স্বর্ণের দোকান পুরো যুক্তরাষ্ট্রে বেশ সুপরিচিত। বর্তমানে কিছুটা মন্দাভাব রয়েছে। তবে এটা কেটে যাবে। জ্যাকসন হাইটস সব সময়ই বাংলাদেশীদের প্রিয় স্থান ছিলো। থাকবেও।
কমিউনিটি এক্টিভিস্ট জাবেদ উদ্দিন বলেন, জ্যাকসন হাইটস হলো কমিউনিটির মানুষদের মিলনমেলার অন্যতম স্থান। এখন কমিউনিটির মানুষ শুধু নিউইয়র্ক কেন্দ্রীক না। অনেকেই সিটি ছেড়ে অনেক স্টেটে চলে যাচ্ছেন। এটা যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিটির প্রসার হচ্ছে। তবে বাংলাদেশীরা জ্যাকসন হাইটস কখনো ছাড়তে পারবেন না। কিছুটা সমস্যা আছে এখানে। যেমন ট্রাফিক, পার্কিং, নিরাপত্তা ঘাটতি। এসব সমস্যা নিয়ে স্থানীয় কমিউনিটি ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ সিটি কর্তৃপক্ষকে অবগত করে সমাধান করলে জ্যাকসন হাইটস আবারো স্ব-গৌরবে ফিরবে।
তিনি আরো বলেন, আগে শুধু জ্যাকসন হাইটসে কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের সুবিধা সহজতর ছিলো। এখন জ্যামাইকাসহ সিটির বিভিন্ন স্থানে কমিউনিটি হল ও পার্টি হল গড়ে ওঠেছে বাংলাদেশীদের উদ্যোগে। তাই স্থানীয়ভাবে অনেকেই নিজ এলাকার পাশেই এসব আয়োজন করতে পারছেন।
কমিউনিটির বিশিষ্ট সিপিএ মোহাম্মদ চিশতি বলেন, এখন শুধু নিউইয়র্ক সিটির ৫ বোরো নয় বিভিন্ন আপস্টেটে কমিউনিটির লোকজন মুভ করছে। কমিউনিটির প্রসার ঘটছে। বছর তিনেক ধরে জ্যাকসন হাইটসে হোমলেস মানুষের উৎপাত ও  কিছুটা নিরাপত্তা ব্যবস্থার অবনতির জন্য এখানে প্রভাব পড়েছে। এছাড়াও এখন অনলাইন ব্যবসার প্রভাবে এখানকার ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়তে পারে বলে আমার ধারণা। তবে এখানকার ট্র্যাডিশনাল রেস্টুরেন্ট, কাপড়ের ও স্বর্ণের দোকানগুলো এখনো সমৃদ্ধ। ঈদ, পূজা কিংবা অন্যান্য উৎসবকে ঘিরে, অতীতের মতো মন্দাভাব কাটিয়ে, জ্যাকসন হাইটসের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার আবারও ফিরবে স্বরুপে এটাই আশা।