পশ্চিমা বিশ্বে ডানপন্থীদের উত্থান এবং বাংলাদেশের করণীয়

ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান
  ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২২

গত কয়েক বছরে ইউরোপের রাজনীতিতে ডানপন্থী ও অতিডানপন্থী দল ও নেতাদের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতালিতে জর্জিয়া মেলোনির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার থেকে শুরু করে জার্মানির ‘Alternative für Deutschland’ (AfD), অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টি, ফ্রান্সের ‘National Rally’,  নেদারল্যান্ডসের ডানপন্থী শক্তির উত্থান এবং সম্প্রতি ব্রিটেনে রিফর্ম ইউকে এর রাজনৈতিক অবস্থান সবই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ইউরোপের রাজনৈতিক কেন্দ্র ক্রমশ চাপের মুখে পড়ছে। এ দলগুলো অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ, সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ, কঠোর বাণিজ্যনীতি এবং স্বার্থনির্ভর পররাষ্ট্রনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি বড় রফতানিকারক ও কৌশলগত অংশীদার, ঝুঁকি মোকাবিলায় নীতি নির্ধারণ জরুরি।
প্রথমত, পশ্চিমা বিশ্ব তথা ইউরোপে ডানপন্থী শক্তির উত্থান কীভাবে বাইরের দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলে, তা বোঝা প্রয়োজন। ডানপন্থী আন্দোলনের ফলে বাণিজ্যনীতি ও বিশেষ সুবিধা কম পূর্বাভাসযোগ্য হয়ে উঠছে। অনেক ইউরোপীয় ডানপন্থী দল অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদকে বহুপাক্ষিকতার প্রতি সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। বাস্তবে এর অর্থ হতে পারে— ইইউ’র জিএসপি/ইবিএ/জিএসপি+ স্কিমের মতো বাণিজ্য সুবিধাগুলো কঠোর করা, শর্ত কঠিন করা, অথবা নতুন চুক্তি বিলম্বিত করা। ইইউ’র সাধারণ বাণিজ্য সুবিধা (GSP) সরাসরি শ্রম, মানবাধিকার ও সুশাসন মানদণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। ফলে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে এসব শর্তের প্রয়োগ বা তদারকি আরও কঠোর হতে পারে। এছাড়া ডানমুখী সরকারগুলো প্রায়ই অভিবাসন, নিরাপত্তা ও ‘মূল্যবোধ’ সম্পর্কিত বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে এবং বহুপাক্ষিক উন্নয়ন অর্থায়নের পরিবর্তে দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা বা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দেয়। এর ফলে উন্নয়ন সহায়তার বাজেট কমতে পারে এবং কঠিন শর্তযুক্ত সহায়তা বাড়তে পারে।
অভিবাসন নীতি কঠোর হলে নিয়মিত অভিবাসনের পথ সংকুচিত হয় এবং প্রবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈরী প্রচার ও কঠোর আইন প্রয়োগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে রেমিট্যান্স, শ্রম চলাচল ও প্রবাসী বিনিয়োগে। যদিও বাংলাদেশের মতো দেশের বড় অংশের রেমিট্যান্স ইউরোপের বাইরে থেকে আসে, তবুও ইউরোপীয় দেশগুলোর জনমত ও নীতি নিয়োগ, ভিসা ও প্রবাসী শ্রমিকদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ওপর প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি, যখন ইউরোপ জাতীয় নিরাপত্তা ও মতাদর্শগত অবস্থানের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়, তখন দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সহযোগিতার চেয়ে কৌশলগত ছাড় দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এর ফলে জলবায়ু অর্থায়ন, বাণিজ্য কূটনীতি এবং শরণার্থী সংকট বা সরবরাহ-শৃঙ্খলের মতো বিষয়ে সহযোগিতা কমতে পারে।
এখন দেখা যাক বাংলাদেশের ওপর  কী ধরনের প্রভাব পরতে পারে। বাংলাদেশ ইইউ অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ বাণিজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে হয়েছে এবং ইইউ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রফতানি বাজার (বিশেষত তৈরি পোশাক খাত)। তাই ইইউ’র বাণিজ্যনীতির পরিবর্তন বা সুবিধা দেওয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
যদি ইইউ শর্ত কঠোর করে, সুবিধা স্থগিত করে বা নতুন চুক্তি বিলম্বিত করে, তবে বাংলাদেশের রফতানি শিল্প, বিশেষ করে পোশাক খাত তাৎক্ষণিক ব্যয় সংকটে পড়বে। শুধু শর্ত আরোপের সম্ভাবনাই অনিশ্চয়তা তৈরি করে এবং বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে। তদুপরি, সামাজিক উন্নয়ন, জলবায়ু সহনশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা হ্রাস পেতে পারে, কারণ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বা অভিবাসন প্রতিরোধের মতো রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে অর্থায়ন বাড়ানো হতে পারে। অভিবাসন নীতি কঠোর হলে বৈধ শ্রম অভিবাসনের সুযোগ কমে যাবে, বহিষ্কার বা আইনি পদক্ষেপ বাড়বে এবং প্রবাসী সম্প্রদায় আরও বেশি বৈরী রাজনীতির শিকার হবে। এর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ওপর পড়বে।  

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ জরুরি। সবার আগে বাজার বৈচিত্র্যকরণে জোর দিতে হবে। একক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে বিকল্প বাজার ( কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া) প্রসারিত করা এবং উচ্চমূল্যের পণ্য (টেকনিক্যাল টেক্সটাইল, উচ্চমানের পোশাক) রফতানি বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে পূর্বপ্রস্তুতিমূলক সংস্কার করা দরকার, যেমন- স্বাধীন শ্রম পরিদর্শনের ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, বিচারব্যবস্থায় দ্রুততা আনয়নের উদ্যোগ গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক যাচাইকে স্বাগত জানানো।
এছাড়া, বহুমাত্রিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু সরকার নয়, বরং সংসদ, শ্রমিক সংগঠন, ক্রেতা ও ইউরোপীয় নাগরিক সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে— শ্রমিক নিরাপত্তা, জলবায়ু সহনশীলতা এবং বাণিজ্য সহজীকরণে সহযোগিতার মাধ্যমে। সেই সাথে, দেশীয় সুরক্ষা শক্তিশালীকরণ জরুরি। এ ক্ষেত্রে  শ্রম মান উন্নতকরণ ও বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে বাংলাদেশ মানবাধিকার প্রশ্নে বাইরের চাপ কমাতে পারে। এর পাশাপাশি বিকল্প অর্থায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বহুপাক্ষিক ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন অংশীদার এবং বেসরকারি বিনিয়োগ উৎস থেকে অর্থায়ন বাড়াতে হবে, যাতে একক দাতা ব্লকের ওপর নির্ভরশীলতা কমে।
ইউরোপে ডানপন্থী উত্থান মানেই উন্নয়নশীল দেশের জন্য সর্বনাশ নয়। তবে এটি শর্তযুক্ত বাণিজ্য, কূটনৈতিক টানাপোড়েন ও অভিবাসন-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের জন্য, যেটি ইইউতে বড় রফতানিকারক এবং ইউরোপে সক্রিয় প্রবাসী সম্প্রদায় রয়েছে, পরিস্থিতি আরও সংবেদনশীল। তাই কৌশল হবে দুই ধাপে—একক বাজার বা দাতার ওপর নির্ভরশীলতা কমানো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম ও শাসন মানদণ্ডে বিশ্বাসযোগ্য অগ্রগতি প্রদর্শন করা। এতে রাজনৈতিক চাপ কমবে, বাজারে প্রবেশাধিকার টিকে থাকবে এবং ইউরোপের যেই সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বাংলাদেশ তার নীতি স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারবে।   
লেখক: জন প্রশাসন ও নীতি বিশ্লেষক
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন