একটি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের মেরুদণ্ড। যেখানে নিরাপত্তাহীনতা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, হঠাৎ হরতাল-অবরোধ, ডাকাতি কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা বেশি, সেখানে কোনো টেকসই ও লাভজনক ব্যবসা গড়ে ওঠে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘাটতি আজ বড় এক সংকটে পরিণত হয়েছে।
ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (DCCI)-এর ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র নিরাপত্তা-সংকট, অনিয়ন্ত্রিত বিক্ষোভ ও জোরপূর্বক চাঁদা আদায়ের কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বছরে গড়ে প্রায় ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হন। এসব ঘটনা শুধু ক্ষতি করে না, বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস করে দেয়, যার ফলে নতুন বিনিয়োগও বন্ধ হয়ে যায়।
বিশেষত ঢাকার বাইরে ব্যবসা পরিচালনা করা উদ্যোক্তাদের জন্য এই সমস্যা আরও প্রকট। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, খুলনা ও রাজশাহী অঞ্চলে অনেক উদ্যোক্তাই মাঝেমধ্যে স্থানীয় মাস্তান, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা চাঁদাবাজ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের কাছ থেকে চাপের মুখে পড়েন। উৎপাদনের গতি, পণ্যের গুণগত মান এবং সময়মত ডেলিভারি সবই ব্যাহত হয়।
নারায়ণগঞ্জের এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী নাম না উল্লেখ করার শর্তে বলেন, “আমরা ব্যবসা করতে চাই, কিন্তু প্রতিদিনই কোনো না কোনো ‘সংগঠনের’ নামে চাঁদা দিতে হয়। দিতে না চাইলে ভয় দেখানো হয়, মালামালের গাড়ি আটকে দেওয়া হয়।” তিনি আরও বলেন, “নতুন পুঁজি বিনিয়োগ করতে সাহস পাই না, কারণ জানি না পরদিন আরেকটা ঝামেলা আসবে কিনা।”
বাংলাদেশে ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে হঠাৎ রাস্তা অবরোধ, পিকেটিং, আগুন দেওয়া, গাড়ি ভাঙচুর—এসব ঘটনা প্রতিদিনের ব্যবসার সময়সূচি নষ্ট করে দেয়। এতে পণ্য পরিবহন, সরবরাহ চেইন, কাঁচামাল সংগ্রহ সবই ব্যাহত হয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা (SME) এসব অস্থিরতা সামাল দিতে না পেরে ব্যবসা বন্ধ করে দেন।
বিশিষ্ট একজন ব্যবসায়ী একবার মন্তব্য করেছিলেন, "ব্যবসায়ীদের বড় চ্যালেঞ্জ এখন আর বাজার নয়, বরং বাজারে পৌঁছানো। রাজনৈতিক নিরাপত্তা না থাকলে ব্যবসায়ীরা একধরনের ‘ভয়ের সংস্কৃতি’র মধ্যে পড়ে যায়।” এই বক্তব্য বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতারই প্রতিফলন।
দেশে অনেক উদ্যোক্তা আছে যারা ছোট ও মাঝারি শিল্প স্থাপন করতে চান, কিন্তু স্থানীয় দখলবাজদের কারণে জমি কিনতে পারেন না। আবার যদি জমি কিনতেও পারেন, তবে সেই জমিতে ‘স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের’ অনুমতি ছাড়া কার্যক্রম শুরু করতে পারেন না। এমন ঘটনা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। উদ্যোক্তারা অনেক সময় পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা চাইলেও তারা নানা কারণে নিরুত্তর থাকেন।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ থাকলে শুধু ব্যবসা না, দেশের সার্বিক অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্বব্যাংক এবং IFC-এর Doing Business Report অনুযায়ী, ২০২0 সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে Ease of Doing Business Index-এ ছিল ১৬৮তম। যার একটি বড় কারণ ছিল আইনগত সুরক্ষা ও চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা। এছাড়া বাংলাদেশে কোনো ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গড়ে সময় লাগে ১৪৪২ দিন—প্রায় চার বছর। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোনো কোম্পানির অর্থনৈতিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে যেতে পারে।
দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠন FBCCI বারবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে যে, দেশের ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে হলে প্রথমেই স্থানীয় স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনকে দায়িত্বশীল হতে হবে যাতে ব্যবসায়ীরা নিঃসঙ্কোচে বিনিয়োগ করতে পারেন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে শুধু নীতিমালা দিলেই চলবে না, বাস্তবিক অর্থে একটা নিরাপদ এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও দক্ষ, প্রযুক্তিনির্ভর এবং জবাবদিহিমূলক হতে হবে। একইসাথে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
পোশাক খাতে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি, যেখান থেকে বছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়। কিন্তু সেই খাতে কাজ করা অনেক উদ্যোক্তা মাঝেমধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ, পেমেন্ট ইস্যু, রাজনৈতিক প্ররোচনা ইত্যাদি কারণে বিশৃঙ্খলার মুখোমুখি হন। কখনও পুলিশি সহযোগিতা না পেলে কারখানা বন্ধ রাখতে হয়, শ্রমিক বিক্ষোভে মালিকপক্ষ পালাতে বাধ্য হয়। এসব পরিস্থিতি শুধু আর্থিক ক্ষতির নয়, বরং দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতিরও কারণ।
একজন ব্যবসায়ী যখন প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকেন, তার উদ্ভাবনী মনোভাব লোপ পায়। তিনি শুধু টিকে থাকার চেষ্টা করেন, বড় স্বপ্ন দেখতে সাহস পান না। অথচ ব্যবসা মানেই নতুন কিছু সৃষ্টি করা, বড় স্বপ্ন দেখা এবং সমাজকে এগিয়ে নেওয়া। কিন্তু অস্থির ও অনিরাপদ পরিবেশে তা সম্ভব হয় না।
তথ্যপ্রযুক্তির খাতে কাজ করা উদ্যোক্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, “আমার স্টার্টআপ সফল হলেও কয়েকবার রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে কাঁচামাল সময়মতো আসেনি, ক্লায়েন্টের সঙ্গে ডেলিভারি সময়মতো হয়নি। এতে শুধু টাকা নয়, আমার সুনামও নষ্ট হয়েছে।” তার মতে, স্টার্টআপগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আইনি ও পরিবেশগত নিরাপত্তা।বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছে, তা উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অবদানে। এখন আমাদের লক্ষ্য উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। কিন্তু উন্নত দেশ হতে হলে ব্যবসা-বান্ধব এবং আইনের শাসনভিত্তিক একটা প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, পুলিশ এবং জনগণ—সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসা তখনই সফল হয় যখন সেখানে নিরাপত্তা থাকে, সুশাসন থাকে, আইনের শাসন থাকে। আর এইসবের ঘাটতি মানেই ভয়, ক্ষতি এবং ব্যর্থতা। একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি তখনই সম্ভব, যখন সেই দেশে ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীরা ভয়হীনভাবে কাজ করতে পারবেন। সেই দিক থেকে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এখনই সচেতন হওয়া উচিত—আইন-শৃঙ্খলা শুধু রাজনীতি কিংবা প্রশাসনের বিষয় নয়, বরং এটি সরাসরি ব্যবসার টিকে থাকার বিষয়।সচেতন মহল মনে করেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সবচেয়ে যে বিষয়ে সফলভাবে ব্যর্থ হয়েছে সেই বিষয়টা হচ্ছে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারা অথবা সেই দিকে আন্তরিকভাবে মনোযোগ না দেওয়া। বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে ঠিক করতে হলে সরকারকে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির দিকে গভীর মনোযোগ দিতেই হবে, বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই।
সূত্র: জাগো নিউজ