আওয়ামী লীগ যেটি বুঝতে পারেনি বিএনপিকে সেটি বুঝতে হবে

সাইদুর রহমান
ডেস্ক রিপোর্ট
  ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৯:৪৭

পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের মতো এতো অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ অন্য কোন দেশে আছে কি না জানা নেই। যে দেশে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের আগে ৮০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন, সেই দেশে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ৮০ শতাংশ মানুষ এখন বিএনপির। বাংলাদেশ এমন এক দেশ, যেখানে মানুষ পরিস্থিতি বুঝে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলে। অর্থাৎ বড় একটি অংশ নৈতিকতা বিবর্জিত, ক্ষমতা পূজারি। সেই দেশে রাষ্ট্রের সংস্কারের চেয়ে সকলের মনের সংস্কার আগে জরুরি। 
যে ৮০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের সাথে ছিল, তাদের বড় একটি অংশকে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আর যাদের বাধ্য করা হয়নি, স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে আখের গুছিয়েছিল তারাও নাকি বিএনপির বড় বড় নেতা বা তাদের আত্মীয়। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। অতি আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনাকে চূড়ান্ত ফ্যাসিস্ট বানিয়েছিলো। ৫ আগস্টের পর এই অতি আওয়ামী লীগরা, লুঙ্গির ভেতর থেকে বেরিয়ে প্রকাশ্যে বিএনপি, জামায়াত বা এনসিপির ছায়াতলে আরো বেপরোয়া। 
অতি আওয়ামী লীগরা সংস্কারে সোচ্চার, আওয়ামী লীগের বিচারে সোচ্চার। কী চমৎকার জাতি আমরা! হঠাৎ করে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ এতো দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেলো, সেটি কেউই আমরা খেয়াল করলাম না। ২০০৯ এর জানুয়ারি থেকে ২০২৪ এর আগস্ট প্রায় সাড়ে ১৬ বছর, প্রচণ্ড গরমেও অনেক মানুষ মুজিব কোট পরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, গত শীতেও একজনকেও তথাকথিত মুজিব কোট পরতে দেখিনি। এই সময়ে, রাস্তার সব ছবি বিক্রেতা শুধু শেখ হাসিনা, শেখ মুজিবের ছবিই বিক্রি করতেন, তখন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কিংবা জনাব তারেক রহমানের কোনো ছবি চোখে পড়ত না। কিন্তু আগস্ট ২০২৪-এর পর দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে গেছে। এখন তারা বিক্রি করছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়া, বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের ছবি; শেখ মুজিবের ছবি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আগে যাদের ফেসবুকে হাসিনা, মুজিব বন্দনা ছিলো, ফ্যাসিস্টের পক্ষে জয়গান ছিলো, তারাও এখন আওয়ামী লীগের মন্দ বলছে। পূর্বের সরকারের পক্ষে ছবি বা স্ট্যাটাস ডিলিট বা অনলি মি করে বর্তমানে অতি বিপ্লবী হয়ে একটু সংস্কার বা আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে সোচ্চার হয়ে ইমানী পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হচ্ছেন। বিএনপির ত্যাগীদের কোনঠাসা করে ফ্রন্ট লাইনের দখলে নিয়েছেন। চরিত্রহীন মানুষগুলো যখন আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তখন প্রকৃত রাজপথের সংগ্রামীরা হতাশ হয়ে যান। রাগে, ক্ষোভে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। ত্যাগীদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অতি বিএনপিরা চালকের আসনে চলে যান। এই রাজনীতির পরিণতিও ভালো হবে না।
২০০৯ সালের পর বিএনপির অনেক বড় বড় পদধারী নেতারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। কেউ থাকেন নিজেদের অপরাধে জেলে, কিছু চলে যান পলাতক জীবনে, পরবাসে, আর কিছু টিকে থাকতে আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করেন। বিএনপির সংকটে এরা রাজপথে নামেনি কিন্তু বড় বড় পদে ছিলেন। ৫ আগস্টের পর সেই পদের দাপটে তারা এখন সোচ্চার, ক্ষমতাধর। নিজেদের ২০০১-২০০৬ সালের আধিপত্য ফিরিয়ে আনতে গণহারে ফ্যাসিস্ট চক্রকে পুর্নবাসনও করে যাচ্ছেন। অথচ সংকটে মাঠে নেমেছিলো পদহীন মধ্যম বয়সী ছেলে-মেয়েরা। আজ বিএনপিতে তারা অবহেলিত, হতাশায় নিমজ্বিত। আরও সুচারুভাবে এই জায়গায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে কাজ করতে হবে। 
বিচিত্র স্বভাবের বাংলাদেশিরা বস্তুত আদর্শহীন রাজনৈতিক সুবিধাভোগী। তারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বোঝে না। তারা ক্ষমতার পালাবদলে নিজেরাও ক্ষমতাবান হয়ে যান। এই শ্রেনীর মানুষকে আওয়ামী লীগ শনাক্ত করতে পারেনি। জনগণের ভোটে আগামীতে হয়তো বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। হঠাৎ অতি বিএনপি হয়ে যাওয়া ভালো লক্ষণ না। অতি বিএনপি বনে যাওয়ারা বিএনপির উপকারের চেয়ে ক্ষতি করবে। এখনই বিএনপির উচিত হবে অতি বিএনপি থেকে সতর্ক এবং সাবধানে থাকা। এরা কখনোই বিএনপি করে না, এরা বিএনপির ব্যানারে সুবিধার আশায় অতি বিএনপি হয়ে বস্তুত বিএনপির ক্ষতি করবে। আওয়ামী লীগ যেটি বুঝতে পারেনি, বিএনপিকে সেটি বুঝতে হবে। যে কোন দলে অতি উৎসাহী, অতি সুবিধাভোগীদের নিয়ন্ত্রণ রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত। 

লেখক : সাইদুর রহমান, রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক।