লন্ডন বৈঠক নিয়ে যতো কথা

খায়রুল আনোয়ার
  ১৭ জুন ২০২৫, ১৩:০৪

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক ও যৌথ বিবৃতি ঘোষণা নিয়ে রাজনীতিতে চলছে তুমুল আলোচনা। ঈদ-পরবর্তী ঢাকার রাজনীতিতে লন্ডন বৈঠক যেন কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। যৌথ বিবৃতির পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি শুরু হয়েছে। বিবৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল প্রফেসর ইউনূস-তারেকের বৈঠককে স্বাগত জানিয়েছে। এসব দল বলছে, নির্বাচনের সময় নিয়ে চলমান সংকট এই বৈঠকের ফলে অনেকখানি কেটে যাবে। এসব রাজনৈতিক দলের মতে, এই বৈঠক জাতীয় নির্বাচন ঘিরে অস্থিরতা ও অস্বস্তি দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তবে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা প্রফেসর ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠককে অনেকটা চমক হিসেবেই দেখছেন। কেননা ঈদুল আজহার আগের সন্ধ্যায় ৬ জুন দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথম ভাগে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেশের বৃহৎ দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। প্রফেসর ইউনূসের ভাষণের পর কী এমন ঘটল যে, এক সপ্তাহের মধ্যে এ ধরনের একটি শীর্ষ বৈঠক আয়োজন করা সম্ভব হলো? লন্ডন বৈঠক নিয়ে রাজনীতিতে এখন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। নানারকম হিসাব-নিকাশ মেলানোর চেষ্টা চলছে। জাপান সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন যে, একটি মাত্র দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে। প্রফেসর ইউনূসের এই বক্তব্যে বিএনপি প্রতিক্রিয়া দেখায়। দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণে এপ্রিলে নির্বাচনের সময় ঘোষণার পর বিএনপি রীতিমতো হতাশা প্রকাশ করলেও ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড় থাকে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে হবে। অনেক দিন ধরেই নির্বাচন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধান দলটির দূরত্ব তৈরি হয়। কখনও কখনও এই দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে এপ্রিলে নির্বাচনের সময় ঘোষণার পর বিএনপি মনে করতে থাকে, অন্তর্বর্তী সরকার বৃহৎ রাজনৈতিক দলের দাবি অগ্রাহ্য করল। সরকার জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপিকে রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়ার জন্যই এপ্রিলে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকটা হঠাৎ করেই প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের সময় তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের গুঞ্জন তৈরি হয়। একপর্যায়ে এই গুঞ্জন প্রবল হয়ে উঠলেও প্রথমদিকে উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করে। পরে সরকার ও বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠকের খবর নিশ্চিত করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হয়। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, অনেকটা আকস্মিক মনে হলেও এই বৈঠক নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে এক ধরনের আলোচনা চলছিল। ২-৩ জন উপদেষ্টা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। একটি সংস্কার কমিশনের প্রধানও এ বিষয়ে উদ্যোগী হন। তবে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ এ বৈঠক আয়োজনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বলে জানা যায়। তারা মনে করেন যে, প্রধান রাজনৈতিক দলকে দূরে ঠেলে রেখে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব রাজনীতিতে অস্থিরতা জিইয়ে রাখবে, যা সরকারের জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। উপদেষ্টাদের মধ্যে যারা নির্বাচন বিলম্বিত করে সরকারের মেয়াদ প্রলম্বিত করতে চান, সেসব উপদেষ্টাকে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দূরে রাখা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতার বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হলে দলটি এতে সম্মতি জানায়। এ ক্ষেত্রে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ারও সায় ছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে কেউ কেউ লন্ডন বৈঠকের যৌথ বিবৃতির ভেতর ‘যদি, কিন্তু, তবে’ দেখতে পাচ্ছেন। তারা মনে করেন, ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে নির্বাচনের যে নতুন সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। কেননা যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সংস্কার-বিচারে অগ্রগতি হলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। আগামী ফেব্রুয়ারির আগে সংস্কার ও গণহত্যার বিচারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হবে কিনা, বড় প্রশ্ন সেখানেই।


বহুল আলোচিত বৈঠকটির মূল আলোচনা হয় ‘ওয়ান-অন-ওয়ান’ ফরম্যাটে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তারেক রহমানের মধ্যে। বৈঠকের শুরুতে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং তারেক রহমানের সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ মোট চারজন সহযোগী উপস্থিত ছিলেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠকের প্রথম ১৫-২০ মিনিট সহযোগীদের নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়। এর পর প্রফেসর ইউনূস এবং তারেক রহমান একান্ত আলোচনায় বসেন। তাদের দীর্ঘ বৈঠকের পর একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। যৌথ বিবৃতি পাঠ করেন ড. খলিলুর রহমান। এতে বলা হয়, এপ্রিল থেকে এগিয়ে ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে নির্বাচনের সময় নির্ধারণে একমত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি। তবে এই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচার বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। ড. খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আমরা কোনো সমস্যা দেখি না। নির্বাচনের সময় নিয়ে আমরা দুই পক্ষই যৌথ বিবৃতিতে বলে দিয়েছি। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই তারিখ ঘোষণা করবে। বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কিনাÑ এই প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ নিয়ে দেশে আলোচনা চলছে। আমাদের সিদ্ধান্তÑ ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমরা সংস্কার এবং জুলাই ঘোষণাপত্র করব। আমি নিশ্চিত খুব কম সময়ের মধ্যে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’
লন্ডন বৈঠকে কার জয়, কার পরাজয় হয়েছেÑ কোনো কোনো মহল তা নিরূপণের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে অনেকেই বিষয়টি জয়-পরাজয় হিসেবে দেখতে নারাজ। কারণ দেশ এক ক্রান্তিকালীন সময় অতিবাহিত করছে। আওয়ামী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপদসংকুল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভূরাজনৈতিক জটিল বিষয়। প্রফেসর ইউনূস সরকারের দশ মাস অতিবাহিত হয়েছে। মব সহিংসতাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকার এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। জুলাই সনদ এবং সংস্কারের ক্ষেত্রে কার্যত কোনো অগ্রগতি নেই। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ প্রস্তুত হবে। সংবিধান, নির্বাচন, প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন বৈঠকের পর বৈঠক করে চলেছে। অনেক বিষয়ে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ অর্থাৎ দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এই প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য দলের মতবিরোধ বিরাজ করছে। সংস্কার প্রস্তাব কীভাবে বাস্তবায়ন হবেÑ গণভোট নাকি নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে, এ নিয়েও দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে কিনা, তা নিয়েও নানামুখী আলোচনা শুরু হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে কেউ কেউ লন্ডন বৈঠকের যৌথ বিবৃতির ভেতর ‘যদি, কিন্তু, তবে’ দেখতে পাচ্ছেন। তারা মনে করেন, ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে নির্বাচনের যে নতুন সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। কেননা যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সংস্কার-বিচারে অগ্রগতি হলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। আগামী ফেব্রুয়ারির আগে সংস্কার ও গণহত্যার বিচারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হবে কিনা, বড় প্রশ্ন সেখানেই। বিশেষ করে গণহত্যার বিচার সময়সীমা বেঁধে হয় না। কয়েক মাস আগে আইন উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘অক্টোবরের মধ্যে কোনো একটা রায় আশা করছি।’ তার এই বক্তব্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অসন্তোষ প্রকাশ করে। ওই বিচার প্রক্রিয়ার দিকে আন্তর্জাতিক মহলের তীক্ষè দৃষ্টি থাকবে, এটা বলাই বাহুল্য। বৈঠকের ঘোষণাপত্রে সংস্কার ও বিচার ‘শর্তযুক্ত’ করায় নির্বাচন পিছিয়ে এপ্রিলে, যা প্রধান উপদেষ্টা আগে ঘোষণা করেছিলেন, সেই দিকেই যেতে পারে। অনেকে এমন শঙ্কার কথাও বলছেন যে, বৈরী আবহাওয়া ও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে এপ্রিলে না হলে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে অথবা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন না হলে যে সংকট তৈরি হবে, তা দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার সেই ঝুঁকি নেবে কিনা, তা সরকারকেই ভেবে দেখতে হবে। তবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতার বৈঠক ও যৌথ বিবৃতি রাজনীতিতে বিরাজমান কালো মেঘ সরিয়ে দিয়েছে, এ কথা বলাই যায়।
খায়রুল আনোয়ার : কলাম লেখক
সূত্র: আমাদের সময়