এক দিনে শেখ হাসিনার তিন-তিনটি সাক্ষাৎকার: কীভাবে আর কেন?

ডেস্ক রিপোর্ট
  ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩২

ভারতের আশ্রয়ে থাকা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনটি সাক্ষাৎকার ৩টি আলাদা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বুধবার (২৯শে অক্টোবর) প্রকাশিত হয়েছে।  ব্রিটেনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা এবং মার্কিন ও ফরাসি বার্তা সংস্থা, যথাক্রমে রয়টার্স ও এএফপি-তে প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারগুলোতে মোটামুটি একই ধরনের কথাবার্তা বলেছেন তিনি। এর সবগুলোতেই ইমেইলে পাঠানো প্রশ্নমালার জবাবে লিখিত জবাবই দেওয়া হয়েছে, যার ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদনগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে।
এই ‘সাক্ষাৎকার’-গুলো কীভাবে আর কেন দেওয়া হলো, সেটা খোঁজ করতে গিয়ে বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় জানতে পেরেছে।  সেগুলো ঠিক কী কী, এই প্রতিবেদনে একে একে তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
আগ্রহী ছিল বহু আন্তর্জাতিক মিডিয়াই
শেখ হাসিনার বক্তব্য বাংলাদেশে প্রচারের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ থাকলেও বহু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম যে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণে আগ্রহী, এটা কোনও গোপন বিষয় নয়। এরকম বহু মিডিয়া প্রতিষ্ঠান অনেকদিন ধরেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে তার সাক্ষাৎকার পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে আসলেও এতদিন তাতে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।
আর তিনি এই মুহূর্তে যে ভারত সরকারের আতিথেয়তায় আছেন, তাদেরও বিষয়টি নিয়ে এতদিন আপত্তি ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে যে ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্য অভিযুক্তদের গণহত্যার অভিযোগে বিচার চলছে, তাতে আগামী মাসে (নভেম্বর) তার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার প্রবল সম্ভাবনা আছে। সেই রায় ঘোষণার আগে শেখ হাসিনার বক্তব্যও যাতে বিশ্ববাসী জানতে পারে, সেই জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষে উদ্যোগ নেওয়া হয় এতদিন ধরে পড়ে থাকা অনুরোধগুলোতে সাড়া দেওয়ার। ভারত সরকারও বিষয়টিতে সবুজসংকেত দেয়।
আওয়ামী লীগের পক্ষে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার দিকটি মূলত এখন দেখছেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত।
তারা যখন এই সব প্রতিষ্ঠানকে যোগাযোগ করে জানান, শেখ হাসিনা সাক্ষাৎকার দিতে রাজি; কিন্তু সেটা হবে ইমেইলে—তখন আবার অনেকগুলো মিডিয়া আউটলেট বা বার্তা সংস্থা পিছিয়ে যায়। তার কারণ হলো, ই-মেইলে লিখিত সাক্ষাৎকার হলে ইন্টারভিউয়িকে (এখানে শেখ হাসিনা) প্রতিপ্রশ্ন বা সম্পূরক প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না।
এরপরও অনেক টালবাহানার পর তিনটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার ‘লিখিত’ সাক্ষাৎকার নিতেই রাজি হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে শর্ত ছিল, তিনটি প্রতিষ্ঠানকেই একই দিনে সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশ করতে হবে—কারণ তাতে ‘ইমপ্যাক্ট’ বা অভিঘাত সবচেয়ে বেশি হবে বলে তারা মনে করেছিল।
রয়টার্স, এএফপি ও দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট সেই শর্তে রাজি হওয়ার পরই তাদের প্রশ্নমালার জবাবে শেখ হাসিনা লিখিত উত্তর পাঠান এবং ২৯ অক্টোবর সেগুলো একসঙ্গে প্রকাশিত হয়।
প্রসঙ্গত, কয়েক মাস আগে ভারতের একটি জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্র, ‘দৈনিক যুগশঙ্খে’ও শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল—আর সেটিও দেওয়া হয়েছিল লিখিত আকারে। তবে পত্রিকাটি বাংলাদেশে তেমন পরিচিত না হওয়ায়—তা নিয়ে সম্প্রতি সাক্ষাৎকারের মতো এত আলোচনার সৃষ্টি হয়নি।
‘যা হয়েছে ভারত সরকারের অনুমোদনেই হয়েছে’
দিল্লিতে সিনিয়র কূটনৈতিক সংবাদদাতা নয়নিমা বসু মনে করেন, ‘এক সঙ্গে শেখ হাসিনার তিন-তিনটে সাক্ষাৎকার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বের হলো, ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র না পেলে এটা কিছুতেই সম্ভব হতো না।’
ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান ও তার নিরাপত্তার সার্বিক বিষয়গুলো দেখছে অমিত শাহ্-র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (অবশ্যই জয়শংকরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় রেখে), কাজেই তাদের অনুমতি সাপেক্ষেই গোটা বিষয়টি হয়েছে বলে দিল্লিতে নয়নিমা বসুর মতো বহু পর্যবেক্ষকই নিশ্চিত করেছেন।
নয়নিমা বসু আরও বলেন, ‘সাক্ষাৎকারগুলোতে তিনি যে ধরনের সাহসী কথাবার্তা বলেছেন। বেশ পরিষ্কার করেই বলেছেন, আপাতত তিনি ভারতেই থাকবেন—সেটাও ভারত সরকারের অনুমোদন ছাড়া বলেননি বলেই আমি নিশ্চিত।’
আসলে ভারতের আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনাকে মুখ খুলতে দেওয়া উচিত কিনা—এই বিষয়টি নিয়ে গত পনেরো মাসে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে। বাংলাদেশ বারে-বারেই বলেছে, ভারতের উচিত নয় শেখ হাসিনাকে এমন কিছু বলতে দেওয়া যাতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, কিন্তু ভারত সেই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়নি।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ব্যাংককে এই বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছেও উত্থাপন করেছিলেন, যার জবাবে মোদি জানান ‘এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কারও মুখে লাগাম টানা সম্ভব নয়!’
কিন্তু শেখ হাসিনাকে অনলাইনে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে দেওয়া এক জিনিস, আর আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ‘সাক্ষাৎকার’ প্রকাশ করতে দেওয়া আরেক জিনিস। দিল্লিও অনেক ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
তবে নিরাপত্তাগত ঝুঁকির কথা ভেবে ভারত সরকার শেখ হাসিনার ‘মুখোমুখি’ কোনও সাক্ষাৎকারে এখনও সায় দেয়নি—যে কারণে ওই গণমাধ্যমগুলোতে লিখিত/ই-মেইল সাক্ষাৎকারেই রাজি হতে হয়েছে।
শেখ হাসিনাকে ভারত সরকার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে কোনও একটি স্থানে রেখেছে, যেটি তারা এখনও প্রকাশ করতে রাজি নয়। 
গত কয়েক মাসে যে হাতেগানা কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা তার সঙ্গে ‘ইন পার্সন’ দেখা করেছেন সেটাও করা হয়েছে শেখ হাসিনার ‘বাসস্থান’ থেকে দূরে অন্য কোনও জায়গায়। এই গোপনীয়তার জায়গাটায় ভারত সরকার এখনও কোনও শিথিলতা দেখাতে রাজি নয়। 
কেন নির্বাচন বয়কটের ডাক দিলেন শেখ হাসিনা?
দিল্লিতে বিশ্লেষকরা আরও একটা বিষয় নিয়েও এখন মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারছেন—ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ যে তাতে লড়ার সুযোগ পাচ্ছে না, এই বাস্তবতা শেখ হাসিনাও এখন মেনে নিয়েছেন।
ঠিক এই কারণেই তিনি দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ-বিহীন নির্বাচন তারা যেন সরাসরি বয়কট করেন।
বাংলাদেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে এখনও ভারতের আনুষ্ঠানিক ও ঘোষিত অবস্থান হলো—সেই নির্বাচন হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) ও পার্টিসিপেটরি (অংশগ্রহণমূলক)।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বক্তব্যকে অনেকেই ব্যাখ্যা করছেন এভাবে—ভারত চায় যে কোনোভাবে হোক, সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়, না হলে তারা সেই নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেবে না বা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করবে না। এই কথার ওপর ভিত্তি করে বহু আওয়ামী লীগ সমর্থকও আশায় বুক বেঁধেছিলেন—ভারত হয়তো শেষ মুহূর্তেও এমন কিছু করবে যাতে আওয়ামী লীগকে ভোটে লড়তে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ বাড়ে।
কিন্তু নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে ‘কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া’ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পক্ষে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেওয়া অসম্ভব।
আর ভারতের পক্ষে বা আন্তর্জাতিক বিশ্বের পক্ষেও এমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই, যাতে বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রতীকে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। বাংলাদেশও এই ব্যাপারে তাদের অনমনীয় ও দৃঢ় অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছে।  
সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা যে ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছেন, সেটাও যে এই উপলব্ধি থেকেই—দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা সে বিষয়ে মোটামুটি নিঃসংশয়।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন