
গণভোটে পাস হওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো নির্দিষ্ট সময়ের পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যে প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশন দিয়েছে, তাকে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের জারি করা লিগ্যাল ফেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) এবং আইয়ুব খান প্রবর্তিত বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেছে বিএনপি।
দলটির অভিমত, কমিশনের সুপারিশে ঠিক একইভাবে দুটি দলের প্রস্তাব ও ঐকমত্য কমিশনের চিন্তা-ভাবনা জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো এগুলো বাংলাদেশে আনার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় এ আলোচনা হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
গতকাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আদেশের খসড়ায় নোট অব ডিসেন্টের (ভিন্নমত) উল্লেখ না রাখাকে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা বলে উল্লেখ করেছেন। পৃথক অনুষ্ঠানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, মনে হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং দু-তিনটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সুপারিশ নিয়ে বিএনপির অভিমত, নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতির পরও তা বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় বিএনপি বিস্মিত, ক্ষুব্ধ।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে বলা হয়েছে, আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করবে। গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো এই সময়ের মধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে লন্ডন থেকে সংযুক্ত ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। নেতারা গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়কে ইয়াহিয়া খানের এলএফও এবং আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন।
লিগ্যাল ফেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও), ১৯৭০ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জারি করা একটি ফরমান। এতে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের নীতি উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ এই এলএফও ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, আইনসভায় ৩০০টি আসন থাকবে। ফ্রেমওয়ার্কে রাষ্ট্রের দুই অংশের জন্য সংখ্যানুপাতের কথা বলা হয়। আরও উল্লেখ করা হয়, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের ১২০ দিনের মধ্যে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে। তবে এই সময়ের মধ্যে নতুন আইনসভা সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হলে নতুন নির্বাচন দেওয়া হবে।
অন্যদিকে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ হচ্ছে ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান প্রবর্তিত একটি পরোক্ষ নির্বাচনভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা, যা মূলত তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার একটি উপায় ছিল। এই ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ সরাসরি রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচন করত না। বরং ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ নামে পরিচিত প্রায় ৮০ হাজার স্থানীয় জনপ্রতিনিধির একটি নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হতো, যাদের মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা নির্বাচিত হতেন। এই ব্যবস্থার অবসান ঘটে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতনের পর।
বৈঠকে নেতারা বলেন, ঐকমত্য কমিশন যা করেছে তা জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এটা করে কমিশন চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্য সৃষ্টি করছে। বিএনপি একে জাতীয় নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে না করার ‘অপচেষ্টা’ হিসেবে দেখছে।
বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
এ প্রতিবেদন লেখার সময় গতরাতেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জরুরি বৈঠক করছিলেন। আজ দুপুর ১২টায় দলটি সংবাদ সম্মেলন করে ঐকমত্য কমিশনের আদেশের খসড়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে।
নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গত মঙ্গলবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায়-সম্পর্কিত সুপারিশ দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি ছিল সনদে; তা বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এটা ঐক্য হতে পারে না। তাহলে এই কমিশন কেন করা হয়েছিল?
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ড. ইউনূস, আপনি জনগণের সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যেটুকু সংস্কার দরকার, সেগুলো করে নির্বাচন দেবেন। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে যে সংসদ হবে, সেই সংসদ সব সংস্কার করবে। এর বাইরে গেলে, ব্যত্যয় হলে আপনার সরকারকে এর দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, সব সংকটের মূলে সত্যিকার অর্থে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন। নির্বাচন যত দেরি হচ্ছে তত বেশি ফ্যাসিবাদীরা শক্তিশালী হচ্ছে, যারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল দেখতে চায়। যারা নৈরাজ্য তৈরি করতে চায় তারাই নির্বাচন পেছানোর কথা বলছে।
‘রেফারিকে আমরা কখনও গোল দিতে দেখিনি’
গতকাল রাজধানীতে এক সেমিনারে বক্তব্য দেওয়ার সময় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, কমিশন আদেশের যে খসড়া দিয়েছে, তাতে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের পূর্ণ প্রতিফলন তাতে ঘটেনি। তিনি বলেন, রেফারিকে আমরা কখনও গোল দিতে দেখিনি। এখন মনে হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং দু-তিনটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের কাজ ছিল ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। তারা যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে শুধু জাতি বিভক্ত হবে, অনৈক্য হবে। ঐকমত্য হবে না। এর ভিত্তিতে তারা কী অর্জন করতে চায়– আমরা জানি না। আমরা সরকারকে তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় দেখতে চাই। তাদের কর্মকাণ্ডে যেন জাতি আশ্বস্ত হতে পারে; ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার সময় আমার মনে হয়েছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরও দুই-তিনটি দল তারা একপক্ষ; আমি বিপক্ষে খেলছিলাম। সেই হিসেবে জাতির পক্ষেই আমরা দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে, কিছু দলের প্রস্তাব এবং ঐকমত্য কমিশনের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা জাতির ওপর জবরদস্তিমূলক আরোপের চেষ্টা চলছে।
সালাহউদ্দিন বলেন, সংবিধানের বিভিন্ন রকম সংশোধনের ৪৮টি প্রস্তাবসহ সনদ তারা (কমিশন) আদেশের মধ্যে তপশিল হিসেবে সংযুক্ত করেছে। বলেছে, এগুলোর ওপরে গণভোট হবে। তাই যদি হয়, তাহলে ১২ মাস ধরে এই কসরত কেন করা হলো?
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কমিশনে ঐকমত্য হয়েছিল– যেসব রাজনৈতিক দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, তা তারা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করবে। যদি সেগুলো জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হয়, তবে তারা সেভাবে বাস্তবায়ন করবে।