ফরমায়েশি ও গায়েবি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ও কারাবন্দিদের মুক্তির দাবিতে প্রধান বিচারপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বিএনপি। মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) দুপুরে দলের পক্ষ থেকে কয়েকজন আইনজীবী এই স্মারকলিপি প্রদান করেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, দেশের সব নাগরিক সমান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের জন্য এ সংবিধানসিদ্ধ অধিকারটি যেন প্রযোজ্য নয়। যার প্রমাণ আমরা সর্বক্ষেত্রে দৃশ্যমান দেখতে পাচ্ছি। বর্তমান সরকার হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা গায়েকি মামলাকে বিরোধী দল দমনের প্রধান অবলম্বনে পরিণত করেছে। এই কাজে তারা রাষ্ট্রের পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। সরকার-সরকারি দল বিচার বিভাগকে তাদের অপতৎপরতার প্রধান বাহনে পরিণত করেছে। মিথ্যা, ভুয়া, গায়েবি মামলায় স্বজনদের দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ সর্বস্তরের হাজার হাজার নেতাকর্মী মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ।
গ্রেপ্তারের পর তাদের অনেকের ওপর চালানো হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। অনেককে আটকের পর দীর্ঘদিন অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হয়েছে। সংবিধান ও ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করার বিধান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা করা হচ্ছে না। পুলিশি হেফাজতে চালানো হচ্ছে নির্মম নির্যাতন। আবার অজ্ঞাত স্থান থেকে আদালতে হাজির করার পর পুলিশি রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে এবং রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা হচ্ছে। নির্যাতন থেকে বাঁচাতে পরিবারের কাছ থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা দাবি করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃত অনেককে নির্যাতন করে মিডিয়ার সামনে তথাকথিত স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য প্রদান করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ সংবিধান ও প্রচলিত আইন এটি কোনোভাবেই অনুমোদন করে না।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে কারাবন্দি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা আপনার দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছি।
বিএনপির মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের নামে ক্ষতিগ্রস্ত বিএনপি পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে এই স্মারকলিপি দেওয়া হয়। খালেদা জিয়া, ফখরুলসহ ৮৮ জন কারাবন্দি এবং সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের তালিকাও দেওয়া হয় এতে।
‘বিএনপি করা কি অপরাধ, আমার স্বামীকে ফেরত চাই’
ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা আবদুল হাই ভুঁইয়া বলেন, ‘আমার ৩ ছেলে ও এক ছেলের বউকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর অমানুষিক নির্যাতন করছে জেলে। তাদের দেখতে গেলে আত্মীয় স্বজনকে আটকে হয়রানি করছে পুলিশ। আমি দেশে-বিদেশের বিবেকবান মানুষকে বলতে চাই, আমরা কীভাবে দিন কাটাচ্ছি, একটু চিন্তা করুন।’
তিন ছেলের গ্রেপ্তারের বর্ণনা দিয়ে আব্দুল হাই বলেন, ‘আমার তিন সন্তানকে কারা অন্তরীণ করা হয়েছে। এক ছেলেকে ১০ বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। বড় ছেলেকে না পেয়ে তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে পুত্রবধূকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে পুলিশ। অথচ, আমার ছেলের বউ রাজনীতিতে জড়িত নন। বিএনপি করা কি আমাদের অপরাধ? আমরা শুধু সুষ্ঠু ভোটের অধিকার চেয়েছি।’
সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবন্দি ও সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের পরিবারের সদস্যরা মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে অংশ নেন। সে সময় তারা এসব কথা বলেন।
ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা লিয়ন হক ও রাজিব হাসানের বোন বলেন, ‘আমার দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এক ভাইকে এক মাস গুম করে পরে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। এক বছর আগে আমার ভগ্নিপ্রতিকে লক্ষ্মীপুরে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। তার অপরাধ, তিনি বিএনপি করতেন। পরে আমরা ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিলে লাশটা ফেরতে দেয়। তারা প্রথমে লাশ পর্যন্ত দিতে চায়নি। প্রধানমন্ত্রীকে বলবো, যদি আমার এবং আমার পরিবারের বাঁচার অধিকার না থাকে, তাহলে আমাদের সবাইকে একসাথে মেরে ফেলুন, একজন একজন করে কষ্ট দিয়ে মারবেন না। আমরা বিএনপির রাজনীতি করে অপরাধ করেছি, আমরা পুরো পরিবার এখন মরতে চাই’।
ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা মুক্তিযোদ্ধা শেখ মনিরুজ্জামানের স্ত্রী বলেন, ‘রাত ২টা বাজে দরজা ভেঙে আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আমার স্বামী বয়স্ক, পুলিশকে কত আকুতি মিনতি করলাম, বয়স্ক-অসুস্থ-নির্দোষ লোকটাকে না নিয়ে যেতে। তারপরও পুলিশ বাসায় ভাঙচুর করে নির্দয়ভাবে তাকে তুলে নিয়ে যায়।’
আমান উল্লাহ আমানের বড় ভাইয়ের মেয়ে বলেন, ‘আমার চাচাকে না পেয়ে পুলিশ আমার বাবাকে নিয়ে নির্যাতন করেছে, রিমান্ডে নিয়েছে। তারপর আমার চাচাকে গ্রেপ্তার করে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের কী অপরাধ? তাদের অপরাধ, তারা তাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনকে চেয়েছিল। তারা বিএনপি করে, এটাই তাদের অপরাধ।’
জেলখানায় নিহত বিএনপি নেতা আবুল বাসারের স্ত্রী বলেন, ‘আমি আমার স্বামী হারানোর বিচার চাই। ওরা আমার সন্তানকে এতিম করেছে, পুলিশ গ্রেপ্তার করে অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতন করেছে। যার ফলে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন এর স্ত্রী বলেন, ‘আমরা কোথায় যাবো! আমার স্বামীর মামলার বাদী পুলিশ, মামলা করলোও পুলিশ, সাক্ষীও দিল পুলিশ। এটা কেমন বিচার?’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহানের স্ত্রী রহিমা শাহজাহান মায়া বলেন, ‘আমার স্বামীকে দুই বছরের জন্য জেল দিয়েছে। তার কোনো দোষ নাই, আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানাচ্ছি।’
২০১৩ সালে গুম হওয়া বিএনপি নেতা কাউসার হোসেনের স্ত্রী মিনা আক্তার বলেন, ‘আমার সন্তানের বয়স ১৩ বছর। তার বুঝ হওয়ার পর সে তার বাবাকে দেখেনি। সে বলে, মা আমার বাবার মুখ কি আর দেখতে পাবো না? তখন আমার বুকটা ফেটে যায়।’
রুহুল কুদ্দুস তালুকদারের মেয়ে ব্যারিস্টার তাবাসসুম বলেন, ‘বাবা গুরুতর অসুস্থ। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত। অথচ তাকে মুক্তি না দিয়ে জেলে ভরে রেখেছে। আমি বাবার মুক্তি চাই।’