দারিদ্র্যের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতেও এবার গোপনীয়তা আর সংখ্যার কাটছাঁটের অভিযোগ উঠেছে। দেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে কোনো সংবাদ সম্মেলন বা সাংবাদিকদের না জানিয়েই। শুধু একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে শেষ করা হয়েছে এত বড় তথ্যের উপস্থাপন। ওই প্রতিবেদনে আগের ৩৬ শতাংশ দারিদ্র্যকে নামিয়ে দেখানো হয়েছে ২৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, তা-ও আবার ২০১৯ সালের পুরোনো তথ্য ঘেঁটে।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশনের আওতাধীন সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)।
২০২১ সালে একই বিষয়ের ওপর একটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, দেশের প্রায় ৬ কোটি ৫১ লাখ মানুষ অর্থাৎ ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু সেবছর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। পরে সেটিকেই কাটছাঁট করে সফলতার রূপ দিয়ে ২০২৫ সালে প্রকাশ করা হলো ২৪ শতাংশ দেখিয়ে।
সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) কোনো সংবাদমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন না করে, কেবল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে সন্দেহ আরও বেড়েছে যে, সরকার কি দারিদ্র্য কমিয়েছে, নাকি কেবল সংখ্যার ব্যবস্থাপনায় কম দেখিয়েছে?
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। অথচ আগের গোপন প্রতিবেদন অনুযায়ী এই সংখ্যা ছিল ৬ কোটির বেশি। গ্রামাঞ্চলে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য শহরের তুলনায় দ্বিগুণ। শহরে হার ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ হলেও গ্রামে তা ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
শূন্য থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রায় ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে, যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের হার ২১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল এবং পার্বত্য এলাকা বান্দরবান, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, সুনামগঞ্জ ও ভোলার মতো জেলায় দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশেরও বেশি।
জিইডির ভাষ্য, ২০১৩ সালে দেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকে (এমপিআই) হার ছিল ৪২ দশমিক ৬৫ শতাংশ, অর্থাৎ (ওই সময়ে) প্রায় ৬ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মধ্যে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৯৮ লাখে। তবে এই হিসাব দাঁড় করানো হয়েছে ২০১৯ সালের এমআইসিএস (মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে) জরিপের ভিত্তিতে, যা সাত বছর আগের তথ্য।
খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশের দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ জিইডি বলছে, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য ২৪ শতাংশ। পরস্পরবিরোধী এই দুই সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘এই রিপোর্টে দারিদ্র্য নয়, সত্যটাই গায়েব।’
এমপিআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরিদ্র মানুষ শুধু আয়হীন নয়, তারা বাসস্থান, নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসেবা, রান্নার জ্বালানি, শিক্ষাসহ অন্তত ১০ সূচকে বঞ্চনার শিকার। এমন ১০ সূচকের মধ্যে এবার নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ‘ইন্টারনেট অ্যাক্সেস’।
এই বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের কাজ করেছে জিইডি, বিবিএস, ইউনিসেফ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপিএইচআই এবং অন্যান্য অংশীদাররা। অথচ এত বড় কাজের ফলাফলই গোপনে সংবাদমাধ্যমকে দূরে রেখে প্রকাশ করা হলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারির ধাক্কায় অন্তত ৩ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে পুরোনো জরিপ দিয়ে বর্তমানের দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে ঢেকে রাখার চেষ্টা উদ্বেগজনক।