গোপালগঞ্জে গতকাল বুধবার সহিংসতার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে যৌথবাহিনী ও পুলিশ। বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় এক হাজার ৫০৭ জন পুলিশ সদস্যসহ সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনের আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে বর্তমান পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ।
এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এতে মোট ১০টি পয়েন্টে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি এ তথ্য জানান।
প্রতিবেদনে বলা হয়
১.ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান স্মরণ করতে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া মানুষের কথা শুনতে ১ থেকে ৩০ জুলাই সারাদেশে মাসব্যাপী ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১৬ জুলাই ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে বেলা ১১টায় গোপালগঞ্জ পৌর উন্মুক্ত মঞ্চে জাতীয় নাগরিক পার্টি জনসমাবেশ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। সমাবেশে অংশ নিতে সকাল সাড়ে ১০টায় বরিশাল মহানগরীর সদর থানার সার্কিট হাউজ এলাকা থেকে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা রওয়ানা দেন।
২. সমাবেশের নিরাপত্তার জন্য সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন তৎপর থাকে। সকাল ৯টায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের একটি সন্ত্রাসী দল গোপালগঞ্জ সদর থানার উলপুরে আইনশৃঙ্খলা ডিউটিতে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এসময় একজন পুলিশ পরিদর্শকসহ তিন পুলিশ সদস্য আহত হন।
৩. বেলা ১১টায় গোপালগঞ্জ সদর থানার কংশুর বাসস্ট্যান্ডে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌর শাখার যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. ওমর ফারুক খান রিপনের নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক সড়কে গাছ ফেলে এবং কাঠ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় গোপালগঞ্জ ইএনওর গাড়ি ওই স্থানে গেলে গাড়ি ভাঙচুর করে সড়ক অবরোধ করে রাখে।
৪. বেলা সাড়ে ১১টায় কোটালীপাড়া থানার অবদার হাট এলাকায় কোটালীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম দারিয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল করে কোটালীপাড়া-পয়সারহাট সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে ২ হাজার ৮০০ জন থেকে ৩ হাজার নেতাকর্মী রাস্তা অবরোধ করে রাখে। বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে সদর থানার কাঠিবাজার এলাকায় গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌরসভার মামুনের নেতৃত্বে ২০০ থেকে ৩০০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ করে।
৫. জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃবৃন্দ গোপালগঞ্জ পৌরপার্ক সভাস্থলে পৌঁছানোর আগে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল ককটেল বিস্ফোরণ করে ঢাল, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মঞ্চে আক্রমণ করে। তারা মঞ্চের ব্যানার এবং চেয়ার ভাঙচুর করে। দুপুর ২টা ১ মিনিটে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে ওঠেন।
৬. এরই মধ্যে দুপুর সোয়া ২টায় গোপালগঞ্জ সদর থানার সাতপাড় বাজার এলাকায় দুর্বৃত্তরা দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। তারা দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে। উচ্ছৃঙ্খল জনগণ রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেয় এবং বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করে।
৭. দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে পদযাত্রা সভা শেষ করে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা সভাস্থল ত্যাগ করেন। পদযাত্রা সভায় আনুমানিক ২০০ জন উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে তাদের গাড়িবহর পরবর্তী পদযাত্রা সভাস্থল মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রহরায় রওয়ানা দিলে গোপালগঞ্জ পৌরসভার লঞ্চঘাটে আওয়ামী লীগ ও এর নিষিদ্ধ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৩টায় গাড়িবহর আটকে দেয়।
৮. সেনাবাহিনী ও পুলিশ উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ করে। এছাড়া নাশকতাকারীরা গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারসহ অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় হামলা করে। এসময় সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। এসব ঘটনায় প্রায় ৪৫ জন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক লোকজন আহত হন বলে জানা যায়।
৯. নাশকতাকারীদের আক্রমণে সেনাবাহিনী ও পুলিশ এনসিপি নেতাকর্মীদের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিরাপদে নিয়ে আসে। পরে ৪টা ৫৮ মিনিটে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে যৌথবাহিনীর সহায়তায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা গাড়িতে করে বাগেরহাট হয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে চলে যান।
১০. আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত চারজনের মরদেহ পোস্টমর্টেম করতে না দিয়ে জেলা হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়।
আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যৌথবাহিনী ও পুলিশ নাশকতার ঘটনায় জড়িত ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার্থে এক হাজার ৫০৭ জন পুলিশ সদস্যসহ সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে বর্তমানে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ।