সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার এক বছর পূর্তি হচ্ছে আগামী আগস্টে। কিন্তু এখনো বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে হাঁটছে।
গত বছরের আগস্টে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো তা বাস্তবায়নের পথ কঠিন। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন এবং নতুন নির্বাচনি রূপরেখা নিয়ে অনিশ্চয়তায় প্রশ্ন উঠছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ২০২৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ‘অ্যা বিগ মিসটেক বাই বাংলাদেশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এগারো মাস পর বাস্তবতা বলছে, পথটা খুব কঠিন। রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত, মে মাসে বড় একটি পদযাত্রা তার প্রমাণ। শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা দেশে রাজনৈতিক প্রতিশোধের সংস্কৃতি আরো গভীর করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য হ্রাস ও শুল্কনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কও ভেঙে পড়েছে, বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার পর থেকে। প্রশ্ন উঠছে, ১৭ কোটি ৪০ লাখ মানুষের এই দেশ কি নতুন সুযোগটি হারিয়ে ফেলবে? প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দাবি করেছেন, তার উদ্যোগ সঠিক পথে আছে। দ্য ইকোনমিস্টকে এক সামপ্রতিক সাক্ষাত্কারে ৮৪ বছর বয়সী ইউনূস বলেন, বাংলাদেশিরা যে গভীর সংস্কার চায় তা সময়সাপেক্ষ।
অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক দিক আছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতে, ২০২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কিছুটা কমে ৩ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়ালেও এটি আগের আশঙ্কার তুলনায় ভালো। প্রবাসী আয় বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কিছুটা বেড়েছে। জুলাই ২০২৪-এ যেখানে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশ, তা মে ২০২৫-এ নেমেছে ৯ শতাংশে। সরকার ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছে এবং বলা হচ্ছে, আগের সরকারের সময় পাচার হওয়া কোটি কোটি ডলারের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এদিকে আইএমএফ ও এডিবি সমপ্রতি বহু বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনও পর্যন্ত সরকারের সংস্কার কার্যক্রম ‘সহজলভ্য’ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। এডিবির একজন বিশ্লেষক চন্দন সাপকোটা বলেছেন, বাংলাদেশ এখনো পোশাক রফতানির ওপরই নির্ভরশীল। অবকাঠামো দুর্বল, আর তরুণদের জন্য যথেষ্ট কাজ তৈরি হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র নতুন নতুন শুল্কারোপ করায় এগুলো সমাধান আরো জরুরি হয়ে পড়েছে।
অর্থনৈতিক সংস্কার বিদেশে বাহবা কুড়ালেও প্রশ্ন উঠেছে সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। ড. ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ ‘সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে’। কিন্তু মার্চে তার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল চীনে। সেখানেই কিছু চুক্তি সই হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে এসেছে, বাংলাদেশ চীন থেকে জেএফ-১৭ ও জে-১০সি যুদ্ধবিমান কিনতে পারে। এগুলো সমপ্রতি পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সংঘাতে ব্যবহার করেছে। ১৯ জুন চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ প্রথম ত্রিপক্ষীয় সম্মেলন করেছে। ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরো অবনতির দিকে। বাংলাদেশি পণ্যের জন্য ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হয়েছে, যা রফতানির খরচ বাড়াবে। ভারতের চেয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে চীনের জনপ্রিয়তাও বেশি। এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ বাংলাদেশি চীনকে ইতিবাচকভাবে দেখেন, যেখানে মাত্র ১১ শতাংশ ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল।
চীনের ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র এক সময় বাংলাদেশের বৃহত্তম সহায়তাদাতা ছিল। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যও তাদের বড় সহায়তা ছিল। তবে সহায়তা কমে যাওয়ার পর এখন আমদানি-রফতানির ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক বসানোর পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যা কার্যকর হওয়ার কথা ৯ জুলাই থেকে। এই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সমপ্রতি বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেছে।
এরপরও সবচেয়ে বড় প্রশ্ন-বাংলাদেশ কত দ্রুত গণতন্ত্র ফিরতে পারবে? আর সেটি কতটা টেকসই হবে? ড. ইউনূস জানিয়েছেন, নির্বাচন হতে পারে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে বা এপ্রিলের পরে নির্বাচন যাবে না। এর আগে ‘জুলাই চার্টার’ নামে একটি দলিলের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের নিয়ম ও কাঙি্ক্ষত সংস্কারের তালিকায় সম্মত হতে বলা হচ্ছে। প্রায় ১৫০টি দল নির্বাচনে অংশ নিতে নিবন্ধন করেছে, যা পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে রয়েছে ছাত্রদের আন্দোলন থেকে উঠে আসা ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)। সরকার নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকদের উঠে আসতে সাহায্য করতে চায়। এটা আশাব্যঞ্জক। তবে সমস্যা হলো, এসব ছোট দল তেমন ভোট পাবে না।
একটি জনমত জরিপ বলছে, মাত্র ৫ শতাংশ ভোটার এনসিপিকে ভোট দিতে চান। বিপরীতে বিএনপি ৪২ শতাংশ ও জামায়াতে ইসলামি ৩২ শতাংশ ভোটে এগিয়ে। উদারপন্থিদের শঙ্কা, জামায়াত ক্ষমতায় এলে ধর্মীয় উগ্রপন্থা বৃদ্ধি পাবে। আর বিএনপিকে অনেক বাংলাদেশিই সমপ্রতি ক্ষমতাচ্যুত হওয়া দলটির মতোই দুর্নীতিপরায়ণ ও আত্মতুষ্ট মনে করছেন। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। মে মাসে জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কাগজে-কলমে এই সিদ্ধান্তকে সাময়িক ও আদালতের রায়ের ওপর নির্ভরশীল বলা হচ্ছে। তবে বিচার শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এতে করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশের একটি বড় ভোটার গোষ্ঠী মনে করতে পারে তাদেরকে ব্যালট বাক্সে যথাযথ পছন্দ বেছে নেওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের প্রতি এখনো একটা উল্লেখযোগ্য সমর্থন আছে। জরিপে ১৪ শতাংশ ভোটার দলটিকে প্রথম পছন্দ বলেছে, যদিও বিশ্লেষকদের মতে, আসল সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলের নাম প্রকাশ্যে বলতে খুব বেশি রাজি হন না। দলটির নেতা মোহাম্মদ আরাফাত দাবি করেছেন, দেশের অর্ধেক মানুষ এখনো আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল।
দলটির অভিযোগ, গত এক বছরে তাদের ২৪ জন নেতা-কর্মী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার ইচ্ছামতো আওয়ামী সমর্থকদের টার্গেট করছে, যা আগের সরকারের দমন-পীড়নেরই পুনরাবৃত্তি। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আইন বিশেষজ্ঞ আরাফাত খান মনে করেন, প্রতিশোধ নয়, টেকসই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সব বাংলাদেশিকে ঐক্যবদ্ধ করা। বাংলাদেশের দরকার এখন একটি ‘নেলসন ম্যান্ডেলা মুহূর্ত’। এছাড়া ইকোনমিস্টের প্রিন্ট সংস্করণের লিডার্স শাখায় ‘আনব্যান দ্য আওয়ামী লীগ’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখাটি অনলাইন ভার্সনে ‘ব্যানিং দ্য অপজিশন ইজ নো ওয়ে টু রিভাইভ বাংলাদেশ’স ডেমোক্র্যাসি’ শিরোনামে প্রকাশ করা হয়েছে।এতে বলা হয়েছে, রোধীদের নিষিদ্ধ করা বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথ নয়।