শুল্ক সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম ও উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগ বাংলাদেশের

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৭ জুন ২০২৫, ২৩:৫১

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কের বোঝা কমাতে সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে ঢাকা। ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক প্রত্যাহারের আশায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) ভিত্তিতে গম ও উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি দেশটির তুলা আমদানির প্রক্রিয়াও সহজ করা হচ্ছে।
এই পদক্ষেপগুলো মূলত আগামী ২৯ জুন দুই দেশের নির্ধারিত বৈঠকে বাংলাদেশ যাতে কৌশলগত সুবিধা নিতে পারে, সেই প্রস্তুতির অংশ। বৈঠকে পাল্টা শুল্ক হারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত ৩ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসন হঠাৎ করে বাংলাদেশসহ একাধিক দেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, যা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের মোট শুল্ক দাঁড় করায় ৫২ শতাংশে। যদিও ঘোষণা অনুযায়ী শুল্ক কার্যকরের দিন ৯ এপ্রিল তা সাময়িকভাবে তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখে যুক্তরাষ্ট্র। এই স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হবে ৯ জুলাই।
এই সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি ঘোচাতে কৌশলগত বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ। সচিবালয়ে বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) খাদ্যসচিব মাসুদুল হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩ লাখ টন গম কেনার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। যদিও রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে কম দামে গম আমদানি করা সম্ভব, তবুও যুক্তরাষ্ট্রের গমের খাদ্যমান ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে, বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় মার্কিন প্রতিষ্ঠান বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরার একটি কৌশল হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ২৯ জুনের বৈঠকে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হলে শুল্ক হার কমে আসতে পারে। বর্তমানে যে কটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে এগিয়ে আছে। ইন্দোনেশিয়া ও আরও কিছু দেশ আলোচনা থেকে পিছিয়ে গেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগের অংশ হিসেবে গত ৭ এপ্রিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য ও স্ক্র্যাপের ওপর শূন্য শুল্ক অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসাসামগ্রীর ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কমানোর প্রস্তাবও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
সেদিনই বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কাছে পৃথক চিঠি পাঠান। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের শুল্ক তালিকায় বর্তমানে ১৯০টি পণ্য শুল্কমুক্ত এবং আরও ১০০টি পণ্যকে এই তালিকায় যুক্ত করার চিন্তা চলছে।
পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক সরাসরি ও অনলাইন বৈঠক হয়। ২১ এপ্রিল ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইউএসটিআরের পক্ষ থেকে ছয়টি বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়, যার জবাব দেওয়া হয় ৪ জুন। এরপর ১২ জুন পাল্টা শুল্ক চুক্তির একটি খসড়া তৈরি করে ১৭ জুন তা নিয়ে অনলাইন বৈঠক করা হয়।
বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, খসড়াটি গোপনীয় এবং জনসমক্ষে প্রকাশযোগ্য নয়। তিনি বলেন, 'আমরা এখন নিজেরাই এ নিয়ে দর-কষাকষি করছি।'
ইউএস সেনসাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২৫০ কোটি ডলার, অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ১২৫ কোটি ডলার। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য এবং আমদানি করে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে বছরে ৬১৫ কোটি ডলারের বাণিজ্য-ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান করছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, 'বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে ইতিবাচক কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ৯ জুলাইয়ের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। মূল সিদ্ধান্ত তখনই জানা যাবে।'
এই মুহূর্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষায় বাংলাদেশ যে কৌশলী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অংশীদারিত্ব বজায় রাখার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা।