বাংলাদেশের রাজনীতি একসময় ছিল আদর্শ মতবাদ আর সংগ্রামের। এখন যেন রাজনীতি হয়ে উঠেছে ব্যান্ডিংয়ের এক বিরাট মঞ্চ, যেখানে আদর্শের চেয়ে প্রতীকের সাউন্ড বেশি জরুরি। ঠিক যেমন সিনেমা হলের টয়লেট প্রখ্যালন কক্ষ থেকে ওয়াশরুম হয়ে যায়। কারণ ওয়াশরুম শুনতে ভালো লাগে।
রাজনীতির মাঠেও মার্কা এখন প্রতীক হয়ে উঠেছে। কারণ সম্ভবত শুনতে ভালো লাগে। তবে শুধু সোনার ভালো লাগায় নয়। প্রতীক হয়ে উঠেছে একেকটা রাজনৈতিক ব্র্যান্ড।
যার পেছনে আছে স্ট্র্যাটেজি মনস্তত্ব আর গণ মানুষকে প্রভাবিত করবার নীরব যুদ্ধ। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এসব কথা বলেন টিভি উপস্থাপক ও সাংবাদিক জিল্লুর রহমান।
তিনি বলেন, এই ব্র্যান্ড রাজনীতির তাজা উদাহরণ কাঁঠাল। এক কমিশনার প্রার্থী কাঁঠাল প্রতীক নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে কাঁঠাল মুড়ি বিলি করলেন ভোটের সকালে।
কাঁঠাল মুড়ি খেয়ে ভোটাররা গোপনে ভোট দিতে গেলেন আর জিতলেন সেই কাঁঠাল মার্কার প্রার্থী। নির্বাচনী রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট যদি মুড়ি কাঁঠালের মাধ্যমে হয়, তাহলে ব্র্যান্ডিংয়ের গুরুত্ব বুঝে নিতে হয় নতুন চোখে। হাতি মার্কা প্রার্থী তো আর সকাল সকাল কারো ঘরে হাতি পাঠাতে পারেন না। ব্র্যান্ডিংয়ের হাওয়ায় এখন ঢেউ তুলছে শাপলা। জাতীয় নাগরিক পার্টি চাইছে জাতীয় ফুল শাপলাকে দলীয় প্রতীক হিসেবে, সঙ্গে রেখেছে কলম ও মোবাইল।
কিন্তু জনদৃষ্টি আটকে আছে শুধুই শাপলায়। এ যেন প্রতীক নয়, রাজনীতির নতুন রঙিন ফুল। অথচ এই শাপলা নিয়ে আছে ইতিহাস, আছে বিতর্ক।
জিল্লুর রহমান বলেন, একসময় মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য শাপলা চেয়েছিল কিন্তু পায়নি। এখন এনসিপি চাইছে তাই জোর আলোচনা। কেউ বলছেন এটা বিজেপির পদ্মফুল মার্কার অনুসরণ, কেউ বলছেন শাপলা তো জাতীয় ফুল। প্রতীকের এই লড়াই শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বজুড়ে এক ধরনের পলিটিক্যাল ইকোনমি তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানদের প্রতীক হাতি, ডেমোক্রেটদের গাধা। ইতিহাসের মজা হলো দুটোই এসেছে ব্যঙ্গচিত্র থেকে। এখন এই দুই প্রাণী বোঝা টানে কিন্তু একসঙ্গে নির্বাচনও টানে। ভারতে প্রতীক নিয়ে বিতর্ক নেই বললেই চলে। পদ্মা, পাঞ্জা, কাঁচতে, চোরাফুল—সবই রাজনৈতিক চেতনার ব্র্যান্ড হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রতীকের ব্র্যান্ডিং অনেকটা ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারের মত। যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি ইমেজ নির্মাণ। কেউ শাপলার পেছনে ছুটছে, কেউ কাঁঠালের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ আবার প্রতীক পেয়েই খুশি। কারণ সেটার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় গল্প। যেমন বন্দুক মার্কা। প্রার্থীকে যখন প্রশ্ন করা হয়, বন্দুকটা এক নলা না দু নলা। তখন সে বুঝে যায়, প্রতীকের পেছনেও আছে তথ্য টেস্ট ক্রাক। আসলে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন ব্র্যান্ড মার্কেটিংয়ের এক গ্লামারাস খেলা। গণতন্ত্র এখানে অনেকটা আইটেম সংয়ের মতই শিরোনামে থাকে। কিন্তু গল্পে কম প্রভাব ফেলে।
এই সাংবাদিক বলেন, নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের জন্য ১৪৭টি রাজনৈতিক দলের আবেদন পড়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আদতে বাসা, রেস্তোরাঁ বা বন্ধ দোকান। কেউ বলছেন, অফিস সংস্কারে, কেউ বলছেন এখনো গোছানো হয়নি। ভোটের মাঠে ঝড় তুলবে যেসব দল, তাদের চিহ্ন মেলে না বাস্তবে শুধু পোস্টারে বা ফর্মে। একটি দলের অফিস একটি অ্যাম্বুলেন্স পার্কিং দেখে বোঝা যায় নেতা এসছেন। আরেকটি দলের প্রধান কার্যালয় এখন দুকক্ষের বাসায়, যেখানে পাশের রুমে থাকে ছেলে আর পুত্রবধূ। অনেকে রাজনৈতিক দলের নাম লেখালো, এখনো জানেন না তাদের কমিটিতে কজন সদস্য, মহাসচিব কে কিংবা দলীয় প্রতীক কী চাইছে তারা। তবুও সকলেই নিবন্ধন চায়। কারণ হয়তো মার্কা পেলে একদিন বিক্রি করা যাবে অথবা শাপলা পেলে অন্তত চিংড়ি দিয়ে তরকারি রান্না করা যাবে। কেউ আবার এক ফ্ল্যাটের ভাড়া করা রুমে ব্যানার ঝুলিয়ে দলের অফিস চালাচ্ছেন। কেউ রেস্টুরেন্টের পাশে বসে রাজনীতির স্বপ্ন আঁকছেন। কেউ বলছেন এখন তো এনজিওর যুগ গেছে। রাজনীতির যুগ এসছে। রাজনৈতিক দল খোলার হিরিক পড়ে গেছে। যেমন একসময় পড়েছিল এনজিও খোলার। অনেকটা একটা দল খুলে ফেলি। ভাবনায় যারা রাজনৈতিক দল গঠন করছেন, তারা আসলে ভোটের বাজারে নিজস্ব ব্র্যান্ডিং গড়ে তুলতে চাইছেন।
জিল্লুর রহমান আরো বলেন, বড় দলের বাইরেও আছে বেকারদের জন্য পার্টি, ইনসাফ পার্টি, পাঠা পার্টি, আজাদী পার্টি, শান্তির পার্টি, যেন নাম শুনেই বোঝা যায়, সবাই কারো না কারো দাবি আদায়ের ছলে ভোটটার্মের খেলায় নেমেছে। এসব দলের ভেতর কেউ শূন্য ঘরে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। কেউ ফেসবুক লাইভে নিজেরা নিজেদের প্রেস কনফারেন্স করে। অথচ বাস্তবে লোকজন জানেই না পাশের বাসায় একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয় আছে। এই বাস্তবতা যতই হাস্যকর মনে হোক, এটি আমাদের রাজনীতির নতুন রূপ। প্রতীক এখন শুধু ভোটে ব্যবহৃত একখানা চিহ্ন নয়। এটি একটি বেঁচে থাকার কৌশল। ক্ষমতার কল্পনা প্রবণ মাধ্যম। কেউ মার্কা চায় খাদ্য নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কেউ মার্কা দিয়ে ভবিষ্যতের কনফিডেন্স তৈরি করে। মার্কা এখন শুধু প্রতীক নয়, এটি রাজনৈতিক বিনোদনের নতুন ব্র্যান্ড। এটি এমন এক চাবিকাঠি, যার মাধ্যমে অনেকেই ঢুকতে চান রাজনীতির ফ্ল্যাটে। যদিও সেই ফ্ল্যাটে এখন জানালা নেই। মার্কা ছাড়া দল এখনো দল হয়ে ওঠে না। আর প্রতীক পেলে যেন জার্সি পেয়ে যায় খেলোয়াড়। কিন্তু মাঠ কোথায়? সেটি এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
তিনি বলেন, নির্বাচনের দামামা বাঁধছে। শাপলা, কাঠাল, কলম, মোবাইল, বন্দুক সব ব্র্যান্ডিং প্রস্তুত। তবে একটা সতর্কতা থেকেই যায়। মার্কা দিয়ে শুরু হলেও শেষটা যেন শুধু প্রতীকে না আটকে যায়। আদর্শ কার্যক্রম আর গণসংযোগী শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে বা বদলাতেও পারে কিন্তু একবার যদি জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠতে পারেন তাহলে, সেটাই হবে রাজনীতির আসল ব্র্যান্ড। এখন দেখা যাক কে কতটা সফল হন এই মার্কা যুদ্ধে।
২২
পশ্চিমা বিশ্বে ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা ঝাঁকুনির মধ্যে পড়েছে : মাসুদ কামাল
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা যে ঝাঁকুনির মধ্যে পড়েছে তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, আগে যতবার হাসিনা সরকার ড. ইউনূসের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছে ততবারই পশ্চিমা বিশ্ব এবং পশ্চিমা মিডিয়া ড. ইউনূসের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন তাদের কথাবার্তা শুনে যেন মনে হচ্ছে তারা ড. ইউনূসের বিপক্ষে বলছে। এই পরিবর্তনকে ড. ইউনূস কিভাবে গ্রহণ করবেন? তিনি কি এসব বিষয়ে সচেতন আছেন?
সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্টের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে মাসুদ কামাল বলেন, এতে একটি জরিপ করা হয়েছে যেখানে বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ এনসিপিকে ভোট দিবে বলে জানিয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবে না জেনেও ১৪ শতাংশ মানুষ বলেছে তারা আওয়ামী লীগকেই ভোট দিবে। এমন একটা দলকে আপনি নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন সেটাকে গণতান্ত্রিক দেশগুলো ভালোভাবে নেবে আপনি কীভাবে আশা করেন?
মাসুদ কামাল বলেন, ইকোনমিস্টের মতো পত্রিকা যখন অন্তর্বর্তী সরকারকে এভাবে সমালোচনা করে, তারা যখন বলে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার পথে ভালো কাজ নয়; তখন বুঝতে হবে ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা সারা দুনিয়ায় কমে যাচ্ছে।
মাসুদ কামাল আরো বলেন, কিছুদিন আগে ড. ইউনূস লন্ডন সফরে গিয়েছিলেন। অনেকের সঙ্গে দেখা করেছেন, অনেকের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও পারেননি।
কোথাও সম্মানিত হয়েছেন, আবার কোথাও কিঞ্চিত অপমানিত হয়েছেন। এই সফরে দ্য ইকোনোমিস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের বিষয়ে মাসুদ কামাল বলেন, এই রিপোর্টটি 'ব্যানিং দা অপোজিশন ইজ নো ওয়ে টু রিভাইভ বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি' শিরোনামে তাদের অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করা কোনো পথ হতে পারে না।
তিনি বলেন, ড. ইউনূস এ সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বড় যে পদক্ষেপটা নিয়েছেন সেটা নিয়েই তিনি সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়ে গেছে।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে তিনি ঠিক করেননি। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বলা যাবে না। একটি কালো আইনের মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।