নন-ক্যাডারদের ‘অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা’ ইস্যুতে আবারও উত্তপ্ত হচ্ছে সচিবালয়

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১০ মে ২০২৫, ১১:১০

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং মাঠ প্রশাসনের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিন্ন ‘নিয়োগ বিধিমালা’ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। আর এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বাংলাদেশ সচিবালয়। দেশের শীর্ষ প্রশাসনিক এই দফতরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মৌন সমাবেশ করে ভবিষ্যতে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে সরকারকে অবিলম্বে ‘কর্মচারী নিপীড়নমূলক কালাকানুন’ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়নে কমিটি গঠনের বিরোধিতা, পদনাম পরিবর্তন, সচিবালয়ে রেশনভাতা চালু, নবম পে-কমিশন গঠন, মহার্ঘভাতা প্রদানসহ বিভিন্ন দাবিতে সচিবালয়ে মৌন প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন কর্মচারীরা। গত বৃহস্পতিবার (৮ মে) সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের সামনে বাদামতলায় সমবেত হয়ে এই প্রতিবাদ জানান তারা। এই কর্মসূচির আয়োজন করে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। দাবি পূরণ না হলে আগামী সোমবার (১২ মে) থেকে আরও কঠোর আন্দোলন কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পরিষদের নেতারা। সংশ্লিষ্টদের মতে, এমন কর্মসূচি হলে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের (পিও) মাঠ প্রশাসনে এবং মাঠ প্রশাসনের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের সচিবালয়ে পদায়নযোগ্য করে ‘অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটি কার্যকর হলে কেউ আর দীর্ঘদিন এক কর্মস্থলে থাকতে পারবেন না। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে, আবার মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও সচিবালয়ে বদলি করা যাবে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মচারীরা।
অন্যদিকে, বর্তমান প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা কঠোর হাতে দমন করতে ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। ছয় বছর আগে বাতিল হওয়া ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’-এর কিছু ধারা নতুন আইনে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধিত আইন কার্যকর হলে, দাফতরিক বা প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন ঘটালে কোনও তদন্ত ছাড়াই এক সপ্তাহের নোটিশে চাকরিচ্যুত করা যাবে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে। এতে প্রশাসনে চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাগত দ্বন্দ্ব, অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, ডিসি নিয়োগকাণ্ডে হট্টগোল-হাতাহাতি, সচিবের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে আন্দোলনসহ নানা অস্থিরতা দেখা দিলে সরকার এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথমে বাতিল হওয়া ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশটি কার্যকর করার ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘দেশের বিদ্যমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীদের মাঝে নানা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। কেউ কেউ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে আইনানুগ আদেশ-নির্দেশ মানতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এতে সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।’
এসব বিষয় নিয়ে সচিবালয় থেকে শুরু করে উপজেলা প্রশাসন পর্যন্ত সব পর্যায়ে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, মাঠে সরাসরি আন্দোলন করতে না পারা অনেক কর্মকর্তা সচিবালয়ের এ আন্দোলনে নেপথ্য সমর্থন দিচ্ছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘সচিবালয়ের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির সুযোগ চিরতরে নষ্ট করতেই মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের সঙ্গে একীভূত করে অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা তৈরির চেষ্টা চলছে। আমরা এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ জানাই। সরকার সরে না এলে কঠোর আন্দোলনে যাবো।’

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের কর্মচারীরা জেলার আদালতে বদলি হন না, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মচারীদেরও কোনও লোকাল ব্যাংকে বদলির বিধান নেই। সচিবালয়ের নন-ক্যাডারদের বাইরে পাঠিয়ে তাদের মর্যাদা হরণ করা হবে—এটা কারও জন্যই হিতকর হবে না।’
আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়ক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সচিবালয়ের বাইরে পদায়নের অপচেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নন-ক্যাডার কর্মচারীরা এ সিদ্ধান্ত মানবেন না। সম্মিলিতভাবে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর বলেন, ‘আমরা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। এটি কোনও সাধারণ বিষয় নয়। সচিবালয়কেন্দ্রিক সব সংগঠনের নেতাদের ডাকা হয়েছে। একসঙ্গে বসে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করবো। প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৩ হাজার নন-ক্যাডার কর্মচারী এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সচিবালয়ের নিয়োগবিধি দেখে এই চাকরিতে এসেছি। এখন তাদের বাইরে পাঠানোর কোনও যৌক্তিকতা নেই। এতে বড়ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। নবম পে-কমিশন ও মহার্ঘভাতা নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। পদনাম পরিবর্তনের নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার বলার কিছু নেই। এটি পুরোপুরি সরকারের এখতিয়ার।’