তাহলে সৎ রাজনীতি আর সততার কী মূল্যায়ন

হত্যা মামলায় কারাগারে সাবেক মেয়র আইভী

নিজস্ব সংবাদদাতা
  ০৯ মে ২০২৫, ১২:০১

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সিদ্ধিরগঞ্জের মিনারুল হত্যা মামলায় শুনানি শেষে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে আদালত।
শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাইনুদ্দিন কাদেরের আদালত এ নির্দেশ দেন।
নারায়ণগঞ্জের কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক মো. কাইয়ুম খান জানান, সাবেক মেয়র আইভীকে মিনারুল হত্যা মামলায় আদালতে হাজির করা হয়েছিল। আদালত মামলার শুনানি শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। মামলার পরবর্তী শুনানি ২৬ মে হবে। 
এর আগে শুক্রবার ভোরে শহরের দেওভোগ এলাকায় অবস্থিত চুনকা কুটির থেকে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
শুক্রবার ভোর ৩টার দিকে শহরের দেওভোগ এলাকায় অবস্থিত চুনকা কুটির থেকে আইভীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। 
তবে তিনি দিনের আলো দেখার পর পুলিশের সঙ্গে যাবেন ঘোষণা দিয়ে সকাল সাড়ে ৫ টায় পুলিশের গাড়িতে করে থানার উদ্দেশ্যে বাড়ি ত্যাগ করেন। 
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে পুলিশের একটি দল শহরের দেওভোগ এলাকায় অবস্থিত আইভীর বাড়ি চুনকা কুটিরে প্রবেশ করেন। এসময় আইভীর গ্রেপ্তারের খবরে স্থানীয় বাসিন্দারা ও তার নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে আসলে পুরো এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। 
এসময় আইভীর বাড়ির দিকে যাওয়ার চারটি রাস্তায় বাঁশ, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আইভীর সমর্থকরা। আশেপাশের এলাকার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সকলকে আইভীর বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়ার আহ্বান জানান তারা।


তাহলে সৎ রাজনীতি আর সততার কী মূল্যায়ন
গ্রেপ্তার হওয়ার আগ মুহূর্তে খেদ প্রকাশ করেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।
তিনি বলেছেন, “আমি কি জুলুমবাজ? আমি কি হত্যা করেছি, চাঁদাবাজি করেছি? নারায়ণগঞ্জ শহরে কখনো কোনো বিরোধীদলকে আঘাত করেছি, এমন রেকর্ড কি আমার আছে? তাহলে কীসের জন্যে, কার স্বার্থে আমাকে অ্যারেস্ট করা হলো?”
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আইভীর পৈতৃক বাড়ি ‘চুনকা কুটিরে’ যায় সদর মডেল থানা পুলিশের একটি দল। আইভীকে গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযানের খবরে তখনই সড়কে নেমে আসেন স্থানীয় কয়েক হাজার মানুষ।
তারা ‘রাতের আঁধারে’ আইভীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেবেন না বলে স্লোগান দিতে থাকেন। এরপর সকাল পৌনে ৬টার দিকে শহরের দেওভোগের বাসা থেকে বেরিয়ে পুলিশের গাড়িতে ওঠেন টানা তিনবারের নির্বাচিত মেয়র।
এসময় আইভী বলেন, “বর্তমানের যারা সরকারে আছেন, তারা সাম্যের কথা বলেছেন৷ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপনারা আন্দোলন করেছেন৷ সরকার হটিয়ে নতুন সরকার এনেছেন৷
“তার পরও কেন এই বৈষম্য? তাহলে অনেস্ট রাজনীতি আর সততার কীসের মূল্যায়ন?
গত অগাস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে জেলার অধিকাংশ নেতাকর্মী পালিয়ে গেলেও আইভী নিজ বাড়িতেই ছিলেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি।
পুলিশের গাড়িতে ওঠার আগে শহরের দেওভোগে পৈতৃক বাড়ি ‘চুনকা কুটিরে’ আইভী সাংবাদিকদের বলেন, “আমি তো বাড়িতেই ছিলাম, আমি তো পালাইনি৷ তাহলে আমাকে কেন অ্যারেস্ট করা হলো, এই জবাব জনগণের কাছে চাই, জনগণই দেবে।”
রাতে সমর্থকদের পাশাপাশি আইভীও পুলিশকে বলেন, রাতের আঁধারে তিনি কোথাও যাবেন না৷ কোথাও যেতে হলে সকালে যাবেন৷ সকালে তিনি স্বেচ্ছায় পুলিশের গাড়িতে ওঠেন৷
আইভী বলেন, “আমাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমি ঠিক জানি না৷ যেহেতু প্রশাসন আমার এখানে (বাড়ি) প্রশাসন এসেছে এবং ওনারা বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়েছে৷
“যদিও ওয়ারেন্টের কাগজ তারা দেখাতে পারেন নাই৷ কিন্তু আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমি তাদের সাথে যাচ্ছি৷
“তারা রাতের বেলা এসেছিল, আমি রাতের বেলা বের হতে চাই নাই৷ প্রশাসনের লোকজনকে সারারাত অপেক্ষা করতে হয়েছে, এজন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।”
সাবেক মেয়র আইভীকে পুলিশের গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময়ও হাজারো নারী-পুরুষ তার পক্ষে স্লোগান দেন। রাতভর তারা বাড়ির সামনেই ছিলেন।
এলাকাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আইভী বলেন, “সারারাত আমার মহল্লাবাসী রাস্তায় অবস্থানে ছিলেন, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল কোনো আচরণ তারা করেন নাই, তাদের আমি ধন্যবাদ দিতে চাই৷
“আমি আপনাদের সন্তান, আপনারা যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা আমি আজীবন মনে রাখব৷”
তিনি বলেন, “আমি আলী আহাম্মদ চুনকার সন্তান৷ আমার বাবা দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সাম্যের রাজনীতি করেছে৷ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার কারণে আমার যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে আমি সেই অপরাধে অপরাধী হতে চাই৷ এজন্য যদি আমার বিচার হয়, তাহলে হবে৷”
২০২২ সালে টানা তৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে মেয়র হন সেলিনা হায়াৎ আইভী। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত অগাস্টেই আইভীসহ দেশের ১২টি সিটি মেয়রকে অপসারণ করা হয়।
সাবেক এ মেয়র বলেন, “নারায়ণগঞ্জ শহরে ২১ বছর আপনাদেরকে আমি সেবা দিয়েছি৷ কোনোদিন কেউ বলতে পারবেন না যে- আমি কারও প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে অন্য কোনো দলের প্রতি আঘাত করেছি অথবা কারও সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছি৷
“নিজের দলের ভেতরে থেকেও দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি৷”
তিনি বলেন, “বিরোধ বা মতভেদ থাকলেও এ শহরবাসীর জন্য এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে প্রতিবাদ করি নাই৷ ত্বকীসহ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার আমি চেয়েছি৷ যখন নারায়ণগঞ্জবাসী একদম চুপ ছিল, কেউ কোনো কথা বলে নাই- তখন এ শহরের আওয়াজ তুলেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে৷
“এ শহরের মানুষকে যে কথা বলা শিখিয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শিখিয়েছে, সেই আইভীকে কীসের অপরাধে, কীসের জুলুমে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে আমি ঠিক জানি না৷”
নারায়ণগঞ্জবাসীর উদ্দেশে আইভী বলেন, “যেভাবে আপনারা আমার এবং আমার পরিবারের পাশে ছিলেন, আগামীতেও থাকবেন৷ কারণ আপনারা সকলেই জানেন, আমার আদরের ছোটভাই মোহাম্মদ আলী রেজা রিপনকে এক মাসও হয়নি- হারিয়েছি৷
“সেই ভাইয়ের শোক এখনও ভুলতে পারি নাই৷ তিনটা ছোট-ছোট নাবালক বাচ্চার মাঝখান দিয়ে আমাকে যেভাবে অ্যারেস্ট করা হলো৷ বাচ্চাগুলার মাও নেই৷”
নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা আলী আহমেদ চুনকার মেয়ে আইভী চিকিৎসা শাস্ত্রের ডিগ্রি নিয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলেন বিদেশে, দুই যুগ আগে দেশে ফিরে হঠাৎই রাজনীতিতে নামেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে যখন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুর্দিন চলছিল, তখন দলের হাল ধরেছিলেন আইভী। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে দাঁড়িয়ে
এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সঙ্গে শুরু হয় আইভীর টক্কর। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে চুনকার সঙ্গে যে দ্বন্দ্ব ওসমানদের ছিল, তার জের চলতে থাকে আইভী-শামীম ওসমানের মধ্য দিয়ে।
পৌরসভা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন হলে ২০১১ সালে প্রথম ভোটে আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মেয়র প্রার্থী হন শামীম ওসমান। তখন দলীয় প্রতীকে ভোট না হলেও কেন্দ্রীয় নেতাদের আশীর্বাদ ছিল শামীমের দিকে, কিন্তু সেই লড়াইয়ে উৎরে যান আইভী।
এরপর ২০১৬ ও ২২ সালে আইভীই হন তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।