ধনী দেশগুলোতে কর্মমুখী অভিবাসন কমছে কেন?

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:১৭


গত বছর ধনী দেশগুলোতে কাজের সন্ধানে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এক-পঞ্চমাংশের বেশি কমেছে। দুর্বল শ্রমবাজার এবং অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো ভিসা নীতি কঠোর করায় অভিবাসনের এ প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছে ‘অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (ওইসিডি)।
৩৮টি ধনী ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ নিয়ে গঠিত প্যারিসভিত্তিক সংগঠন ওইসিডি জানিয়েছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে অভিবাসন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই দেশটিতেও অভিবাসীর সংখ্যা নিম্নমুখী হতে শুরু করে।
কোভিড-১৯ মহামারির পর টানা কয়েক বছর অভিবাসন বাড়লেও, গত বছর ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে স্থায়ী কাজের জন্য প্রবেশ করা মানুষের সংখ্যা ২১ শতাংশ কমে প্রায় ৯ লাখ ৩৪ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
ভিসা নীতি কঠোর হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে যুক্তরাজ্যে। ২০২৪ সালে দেশটিতে অভিবাসীর সংখ্যা গড়ে ৪০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। তবে নীতি পরিবর্তন না করা সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতেও শ্রম অভিবাসন কমে ২০১৯ সালের পর্যায়ে নেমে গেছে।
অভিবাসন কমার কারণ কী?
ওইসিডির আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিভাগের প্রধান জ্যঁ-ক্রিস্টোফ ডুমন্ট এ পরিস্থিতির জন্য ‘প্রতিকূল’ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশকে দায়ী করেছেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৫ সালের জন্য বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ২.৮ শতাংশ করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এছাড়া যেসব দেশ ঐতিহ্যগতভাবে সবচেয়ে বেশি অভিবাসী গ্রহণ করে—যেমন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য, তারা গত দুই বছরে কাজের ভিসার শর্ত কঠোর করেছে।
অন্যদিকে, ইউরোপে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের অস্থায়ী আশ্রয় দেওয়ার ফলে শ্রমবাজারের ঘাটতি কিছুটা পূরণ হয়েছে। ওইসিডির তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ৫১ লাখ ইউক্রেনীয় ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে অবস্থান করছেন। এতে বাইরের দেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার চাহিদা কমেছে।
অন্যান্য অভিবাসন
শুধু কর্মসংস্থানের নয়, শিক্ষার্থী অভিবাসনও কমেছে। ২০২৩-২৪ সময়ে ওইসিডি দেশগুলোতে নতুন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আবাসন সংকট এবং অভিবাসন জালিয়াতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ভিসা নীতি কঠোর করায় এ পতন দেখা গেছে।
তবে মানবিক কারণে বা আশ্রয়ের জন্য অভিবাসন বরং বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন প্রশাসনের শেষ সময়ে আশ্রয় আবেদন বা ‘এসাইলাম’ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি, সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপ থেকে ছোট নৌকায় করে অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের ঘটনাও বেড়ে গেছে।
শ্রম ও শিক্ষার্থী অভিবাসন কিছুটা কমলেও মানবিক কারণ বা আশ্রয়ের জন্য অভিবাসনের প্রবাহ বাড়ায় সামগ্রিক সংখ্যায় বড় ধরনের পতন হয়নি। ২০২৪ সালে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে মোট স্থায়ী অভিবাসন আগের বছরের শীর্ষ রেকর্ডের তুলনায় মাত্র ৪ শতাংশ কমেছে।
তবুও ২০২৪ সালে ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে নতুন আগত মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২ লাখে, যা মহামারি-পূর্ব সময়ের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। অস্থায়ী শ্রম অভিবাসনও [যে ভিসায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ নেই] প্রায় ২৩ লাখে স্থিতিশীল রয়েছে, যা ২০১৯ সালের হারের চেয়ে বেশি।
অভিবাসনের সংখ্যা কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে?
২০২৩ সালে ওইসিডি দেশগুলোতে রেকর্ড ৬৫ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এটি ২০২২ সালের রেকর্ড ৬০ লাখ অভিবাসীর চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। এ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ছিল যুক্তরাজ্যে।
২০২৩ সালে কানাডা, ফ্রান্স ও জাপানসহ ওইসিডির এক-তৃতীয়াংশ দেশে রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসী প্রবেশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ১২ লাখ মানুষ বৈধভাবে স্থায়ী হয়েছেন—যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ২০২৪ সালের প্রচারণায় অভিবাসন কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক বিতর্ক সত্ত্বেও বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে কানাডা, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি ছিল অভিবাসন। যুক্তরাষ্ট্রেও অভিবাসীদের কারণে সৃষ্টি হয়েছে ৪০ লাখের বেশি নতুন কর্মসংস্থান।
ভবিষ্যৎ কী?
ওইসিডির কর্মকর্তা জ্যঁ-ক্রিস্টোফ ডুমন্ট মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র কঠোর নীতি নিলেও ২০২৫ সালে সামগ্রিক অভিবাসন ঐতিহাসিকভাবে উচ্চ পর্যায়ে থাকবে, যদিও তা সামান্য কমতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, শ্রমবাজারে অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের হার এখনো বেশ শক্তিশালী।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে বিদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থানের হার প্রায় ৭৬ শতাংশ, যা দেশটিতে জন্মগ্রহণকারী নাগরিকদের কর্মসংস্থানের হারের চেয়ে সামান্য বেশি।
ডুমন্টের মতে, এর পেছনে দুটি কারণ রয়েছে—উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন পেশার জন্য বিশেষ ভিসা ব্যবস্থা এবং নিম্ন দক্ষতা সম্পন্ন অভিবাসীদের সেইসব কাজ করা, যা স্থানীয়রা করতে অনীহা প্রকাশ করেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অভিবাসনবিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ফাবিওলা মিয়ারেরেস আল জাজিরাকে বলেন, ‘কৃষি, নির্মাণ ও স্বাস্থ্য খাতসহ যেসব খাতে স্থানীয় শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এসব খাতে সাধারণত অভিবাসী শ্রমিকেরাই বেশি কাজ করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্পষ্টতই ন্যূনতম মজুরি ও কর্মপরিবেশ—এই দুই বিষয়ই সংকটের বড় কারণ।’
তিনি জানিয়েছেন, ‘বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে, নির্বাচনী রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবেই থাকবে অভিবাসন। এটি মানুষের মধ্যে তীব্র আবেগ সৃষ্টি করে।’