আরাফার ময়দান হাশরের ময়দানের প্রতিচ্ছবি

মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান (রহ.)
ধর্ম ডেস্ক
  ০৫ জুন ২০২৫, ১৯:৩৪

হজ আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সফর। মানুষ যখন দূরদূরান্ত থেকে হজের পবিত্র স্থানগুলোয় পৌঁছে, তখন তার ভেতরে অন্য রকম এক অনুভূতি জেগে ওঠে। তার মনে হয়, সে যেন দুনিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে ‘আল্লাহর রাজ্যে’ প্রবেশ করেছে। সে যেন তার রবকে ছুঁয়ে ফেলেছে, তার চারপাশে ঘুরছে, তারই দিকে দৌড়াচ্ছে, তার নামে কোরবানি দিচ্ছে, তারই দুশমনকে কংকর নিক্ষেপ করছে। সে যেন তার রবের কাছে চাইছে—সবকিছু, যেটুকু সে চায়, সে যেন পাচ্ছে—যেটুকু সে পেতে চায়।

সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্য ফুটে ওঠে আরাফার ময়দানে। পৃথিবীর চারদিক থেকে দলে দলে আল্লাহর বান্দারা ছুটে আসছে। সবার গায়ে একই রকমের পোশাক। কেউ আর নিজের বর্ণ, ভাষা ও দেশের পরিচয় বহন করছে না। সবাই যেন এক জাতি, এক কণ্ঠে উচ্চারণ করছে— লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারীকা লাকা লাব্বাইক। (হাজির আছি হে আল্লাহ, হাজির আছি। তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির।)

এই দৃশ্য দেখে কোরআনের সেই আয়াত মনে পড়ে যায়, যেখানে বলা হয়েছে, যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, তখন হঠাৎ সব মানুষ কবর থেকে উঠে এসে তাদের রবের দিকে দৌড়াবে। (সুরা ইয়াসিন: ৫১)

আসলে আরাফার ময়দান হলো কেয়ামতের ময়দানের প্রতিচ্ছবি। এটি হলো দুনিয়ার জীবনে থেকে ভবিষ্যতের জিন্দেগির জীবন্ত ছবি দেখা।
এক হাদিসে এসেছে—আরাফার ময়দানে উপস্থিত হওয়াটাই হজের মূল আমল। (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৫৫)
এ থেকেই বোঝা যায়—হজের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী। তা হলো—মানুষ যেন কেয়ামতের সেই দিনের কথা স্মরণ করে, যে দিন তাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। যে দৃশ্য একদিন বাস্তব হবে, সে যেন আজই তাকে হৃদয়ে ধারণ করে নেয়।
কাবঘর এক আল্লাহর ঘর। এ ঘর নির্মাণ করেছেন দুই মহান নবি—হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)। এ ঘরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের জীবন ও ত্যাগের বিস্ময়কর ইতিহাস। এরপর এসেছে রাসুলুল্লাহর (সা.) পবিত্র জীবন এবং তার সাহাবাদের নিঃস্বার্থ আল্লাহভীতি ও ইবাদতের নিদর্শন, যেগুলো এ ঘরের আকাশে-বাতাসে জড়িয়ে আছে।
মানুষ এই ইতিহাস পড়ে বড় হয়। ছেলেবেলা থেকে হজের সফর পর্যন্ত এসব শুনতে শুনতে তা তার মনে গেঁথে যায়। যখন সে নিজে কাবা শরিফের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন মনের সেই জমা স্মৃতিগুলো হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠে। সে নিজেকে এক জীবন্ত ইতিহাসের সম্মুখে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পায়—আল্লাহর ভয়ে কাঁপা, আল্লাহর ভালোবাসায় পোড়া সেই ইতিহাস; আল্লাহর পথে সর্বস্ব ত্যাগ করার, তার সামনে নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার এবং তাকে চূড়ান্ত মালিক হিসেবে পেতে চাওয়ার ইতিহাস।
এই অনুভূতি যেন কাবা শরিফের রূপে দৃষ্টিগোচর হয়। এ ইতিহাস তাকে চুম্বকের মতো টানে, তার হৃদয়কে গলিয়ে দেয়, তাকে বদলে দেয়। সে যেন আর আগের সেই মানুষ থাকে না।
১৯৮২ সালে আমি যখন হজে যাই, সেই হজযাত্রার স্মৃতিচারণায় লিখেছিলাম—‘আমার প্রতিদিনের রুটিন ছিল—বাবুল হিজরার পাশে গিয়ে জমজমের পানি দিয়ে অজু করা, তারপর সেই পানি পান করে তৃপ্ত হওয়া। এরপর মসজিদুল হারামে প্রবেশ করা। আমি প্রায়ই ওপরের তলায় চলে যেতাম, কারণ সেখানে ভিড় কম থাকায় কিছুটা প্রশান্তি থাকত। সেখানে নামাজ পড়তাম, কোরআন তিলাওয়াত করতাম, কাবা শরিফের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবেই কেটে যেত, সময়ের কোনো হিসাব থাকত না। কতক্ষণ কেটেছে তা বোঝাই যেত না। তবু, যখন ফিরে আসতাম, মনে হতো—এখনো মন ভরেনি। কাবার সামনে বসে অন্তরের যে অবস্থা হতো—তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

লেখক: বিশ্বখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ