বনি ইসরাইলের বাদশাহ তালুত ও তার ছেলেরা যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর হজরত দাউদের (আ.) বনি ইসরাইলের বাদশাহ হন। তিনি একইসাথে বাদশাহ ও আল্লাহর নবি ছিলেন। তার ওপর আল্লাহ তাআলা যাবুর অবতীর্ণ করেছিলেন। দাউদ (আ.) ছিলেন মনোহর কণ্ঠস্বরের অধিকারী। তিনি যাবুর পাঠ করতেন এমন সুমধুর কণ্ঠে যা শুনলে হৃদয় বিগলিত হতো। তিনি যখন তাসবিহ পাঠ করতেন তখন পাহাড় ও পাখিরাও তার সঙ্গে তাসবিহ পাঠ করতো। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاذْكُرْ عَبْدَنَا دَاوُودَ ذَا الْأَيْدِ إِنَّهُ أَوَّابٌ إِنَّا سَخَّرْنَا الْجِبَالَ مَعَهُ يُسَبِّحْنَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِشْرَاقِ وَ الطَّیۡرَ مَحۡشُوۡرَۃً كُلٌّ لَّهٗۤ اَوَّابٌ
আমার শক্তিশালী বান্দা দাউদকে স্মরণ কর; সে ছিল অধিক আল্লাহ অভিমুখী। আমি পর্বতমালাকে অনুগত করেছিলাম, তার সাথে এগুলো সকাল-সন্ধ্যায় আমার তাসবিহ পাঠ করত। আর সমবেত পাখীদেরকেও (অনুগত করেছিলাম); প্রত্যেকেই ছিল অধিক আল্লাহ অভিমুখী। (সুরা সোয়াদ: ১৭, ১৮)
অর্থাৎ পাখিরা তার মনোহর কণ্ঠস্বর শুনে জড়ো হতো এবং তার সঙ্গে তাসবিহ পাঠ করতো। ইমাম তাবারি (রা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা পাহাড় ও পাখিদের আদেশ দিয়েছিলেন যেন দাউদ (আ.) তাসবিহ পাঠ করলে তারাও তার সঙ্গে তাসবিহ পাঠ করে। ইসরায়েলি রেওয়ায়াতে এসেছে, আল্লাহ তার কোনো সৃষ্টিকে দাউদের মতো কণ্ঠস্বর দেননি। তিনি যখন যাবুর পাঠ করতেন, তখন বন্য পশুরাও আকৃষ্ট হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত, এমন কি তখন তাদের গলাও ধরা যেত, কারণ তারা তার কণ্ঠস্বর শুনে এতটাই বিমুগ্ধ হতো যে, কেউ গলা ধরে ফেললেও তারা প্রতিরোধ করত না।
দাউদ (আ.) একজন দক্ষ কর্মকার ছিলেন। বাদশাহ হয়েও তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা নিতেন না। বরং তিনি নিজ হাতে বর্ম তৈরি করে তা বিক্রি করে উপার্জিত অর্থে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আল্লাহ তাআলা তার জন্য তার কাজ সহজ করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا دَاوٗدَ مِنَّا فَضۡلًا یٰجِبَالُ اَوِّبِیۡ مَعَهٗ وَ الطَّیۡرَ وَ اَلَنَّا لَهُ الۡحَدِیۡدَ اَنِ اعۡمَلۡ سٰبِغٰتٍ وَّ قَدِّرۡ فِی السَّرۡدِ وَ اعۡمَلُوۡا صَالِحًا اِنِّیۡ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ
আর অবশ্যই আমি আমার পক্ষ থেকে দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম। (আমি আদেশ করলাম) ‘হে পর্বতমালা, তোমরা তার সাথে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর’ এবং পাখিদেরকেও (এ আদেশ দিয়েছিলাম)। আর আমি তার জন্য লোহাকেও নরম করে দিয়েছিলাম। (এ নির্দেশ দিয়ে যে) ‘তুমি পরিপূর্ণ বর্ম তৈরী কর এবং যথার্থ পরিমাণে প্রস্তুত কর’। আর তোমরা সৎকর্ম কর। তোমরা যা কিছু কর নিশ্চয় আমি তার সম্যক দ্রষ্টা। (সুরা সাবা: ১০, ১১)
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ عَلَّمۡنٰهُ صَنۡعَۃَ لَبُوۡسٍ لَّكُمۡ لِتُحۡصِنَكُمۡ مِّنۡۢ بَاۡسِكُمۡ فَهَلۡ اَنۡتُمۡ شٰكِرُوۡنَ
আর আমি তাকে তোমাদের জন্য বর্ম বানানো শিক্ষা দিয়েছিলাম। যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করতে পারে। সুতরাং তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে? (সুরা আম্বিয়া: ৮০)
আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, দাউদের (আ.) জন্য যাবুর তিলাওয়াত সহজ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি তার পশুযানে গদি বাঁধার নির্দেশ দিয়ে যাবুর তিলাওয়াত শুরু করতেন। তারপর গদি বাঁধার আগেই তিনি যাবুর তিলাওয়াত করে শেষ করে ফেলতেন। তিনি নিজের হাতে উপার্জন করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। (সহিহ বুখারি: ৩৪১৭)
হজরত দাউদ (আ.) আল্লাহ তাআলার ইবাদতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতেন। তিনি এক দিন পরপর রোজা রাখতেন। রাতের এক তৃতীয়াংশ নামাজে কাটাতেন। সাহাবিরা যখন নামাজ, রোজা ও ইবাদতে পূর্ণ মনোযোগ দিতে চাইতেন, তখন নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের নির্দেশ দিতেন দাউদের মতো ইবাদত করতে। তার মতো রোজা রাখতে ও নামাজ পড়তে। তার চেয়ে বেশি ইবাদত করার চেষ্টা করতে নিষেধ করতেন। কারণ নিয়মিত তার চেয়ে বেশি ইবাদত করার সামর্থ্য তাদের ছিল না।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) আনহু বলেন, নবিজিকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার ব্যাপারে সংবাদ দেওয়া হলো যে, আমি বলছি, আল্লাহর কসম! আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন দিনে রোজা রাখব এবং রাতে নফল নামাজ পড়ব। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, তুমি এ কথা বলছ? আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! নিঃসন্দেহে আমি এ কথা বলেছি, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। তিনি বললেন, এই সাধ্য তোমার নেই। তুমি রোজা রাখ এবং (কখনো) ছেড়েও দাও। (রাতের কিছু অংশে) ঘুমাও এবং (কিছু অংশে) নফল নামাজ পড়। মাসে তিন দিন রোজা রাখ। কারণ নেকির প্রতিদান দশগুণ দেওয়া হয়। তোমার এই রোজা জীবনভর রোজা রাখার মত হয়ে যাবে। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশি করতে পারি। তিনি বললেন, তাহলে তুমি একদিন রোজা রাখ, আর দুদিন রোজা ত্যাগ কর। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশি করতে পারি। তিনি বললেন, তাহলে একদিন রোজা রাখ, আর একদিন রোজা ছাড়। এ হলো দাউদের (আ.) রোজা। আর এটা সর্বোত্তম রোজা। কিন্তু আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশি করতে পারি। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এর চেয়ে উত্তম রোজা নেই। (সহিহ বুখারি: ১৯৭৬)
আবদুল্লাহ ইবনে আমরের (রা.) আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় রোজা হলো দাউদের রোজা—তিনি একদিন রোজা রাখতেন, একদিন ইফতার করতেন। আর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় নামাজ হলো দাউদের নামাজ—তিনি রাতের অর্ধেক ঘুমাতেন, এক-তৃতীয়াংশ নামাজ আদায় করতেন এবং এক-ষষ্ঠাংশ আবার ঘুমাতেন। এসব ছিল নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে। ফরজ নামাজ ও রোজা তো যেভাবে আল্লাহ ফরজ করেছেন, সেভাবেই পালন করতে হয়। (সহিহ বুখারি: ১১৩১)