মোদীর ‘শাস্তির যুদ্ধ’ প্রতিবেশীদেরকে ভাবাবে

সালেহ উদ্দিন আহমদ
  ১৪ মে ২০২৫, ১৩:০৮

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে আপাতত বিরতি। যারা কোনো যুদ্ধ চায় না, তাদের জন্য এটি স্বস্তির বিষয়। তবে উভয় দেশের অনেকেই এতে খুশি নন– বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা। অবশ্য সাধারণের মধ্যেও যুদ্ধ বিরতিতে অখুশি মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম হবে না। তারা মনে করেন, তাদের দেশ প্রতিপক্ষের যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারেনি। দুই দেশের সরকারই দাবি করছে, তারাই যুদ্ধে জিতেছে। কোনো পক্ষই এই যুদ্ধে জয়ী হয়নি– সিএনএন এমনটা বলছে। অবশ্য এর যুদ্ধে শেষপর্যন্ত কেউই জয়ী হয় না­– এই আপ্তবাক্যটি বুঝতে সিএনএন লাগে না, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।
ভারত যখন এই যুদ্ধ শুরু করে, তাদের কোনো বড় ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না। বলা যায়, দুটি ছোট লক্ষ্য নিয়ে তারা যুদ্ধে প্রবেশ করে। প্রথমত, কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানকে ‘শায়েস্তা’ করা। দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরীদের ভারতে সন্ত্রাসী হামলার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের যেসব ঘাঁটি রয়েছে, ওগুলো ধ্বংস করা। ভারতের দাবি অনুযায়ী, দ্বিতীয় লক্ষ্যটি যুদ্ধ শুরুর ১৫ মিনিটের মধ্যেই তারা অর্জন করেছে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি ‘প্রশিক্ষণ শিবির’ ভারত ধ্বংস করে দেয়। তবে অন্যত্র এসব শিবির পুনরায় গড়ে তোলা কেবল সময়ের ব্যাপার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের হামলার জবাবে পাকিস্তানও ভারতের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালায়। চার দিনের যুদ্ধের তিন দিনই উভয় পক্ষ সীমান্তের দুই পাশে বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা চালিয়েছে, যাতে বেশ কিছু মানুষ হতাহত হয়েছে। প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা জানতে আরও সময় লাগবে। দুঃখজনকভাবে, বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা ও পাল্টা হামলায় উভয় দেশই নির্লজ্জভাবে অত্যাধুনিক বিমান, মিসাইল ও ড্রোন ব্যবহার করেছে। এই হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যে পাকিস্তানকে ‘শাস্তি’ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা অধরাই থেকে গেছে ভারতের। যাই হোক, উভয়পক্ষকে যুদ্ধ থামাতে হয়েছে। এই যুদ্ধে কে কী পেয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আরও দীর্ঘদিন চলবে।
আসুন দেখি, এই যুদ্ধে বাংলাদেশের কী লাভ বা ক্ষতি হলো? যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। ভারতীয় সরকার এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন বোধ করেনি। বাংলাদেশ উভয় পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। তবে যুদ্ধের মধ্যেও বাংলাদেশের সীমান্তে মানুষ ঠেলে দেওয়ার যে বৈরী মনোভাব ভারত দেখিয়েছে, তা অনেককে আশ্চার্যান্বিত করেছে। একপর্যায়ে আশঙ্কা হচ্ছিল, ভারত কি বাংলাদেশে ‘রোহিঙ্গা ধরনের’ নতুন শরণার্থী শিবির তৈরির পরিকল্পনা করছে? সৌভাগ্যবশত, তারা এই সংখ্যা সীমিত রেখেছে এবং বাংলাদেশ কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে।
যুদ্ধ যদি আরও দীর্ঘস্থায়ী হতো, তাহলে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় আশঙ্কা তৈরি হতো। ভারত থেকে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের আমদানি ব্যাহত হলে বাংলাদেশ বড় বিপদে পড়ত।

একটি দৈনিক সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য মনজুর হোসেন বলেছেন, “ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য আছে। সেক্ষেত্রে যদি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের ব্যাপ্তি ও সময় বেশি হয় সেটি অবশ্যই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত হবে। কেননা ভারত থেকে আমাদের অনেক খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। যুদ্ধের কারণে সেসব পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। ফলে দেশের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এর প্রভাবে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে।” সৌভাগ্যক্রমে, যুদ্ধ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
আমার একটি বড় আশঙ্কা ছিল, দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাস্তায় বিক্ষোভ বা অশান্তি শুরু করতে পারে। এসব দলের অনেকে ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের সমর্থক। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, এমন কিছু ঘটেনি। এমনকি গণমাধ্যমে বিবৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। পরিস্থিতি জটিল না করার জন্য এই দলগুলোকে সাধুবাদ জানাতে হবে।
তবে এই যুদ্ধের পর ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্কে টানাপোড়েন ও সন্দেহ আরও বাড়বে। ভারত যেভাবে ‘শাস্তি’ দেওয়ার নামে যুদ্ধ শুরু করেছে, তা বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের জন্য ‘ঝিকে মেরে বউকে বোঝানো’র মতো অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে মতবিরোধের ক্ষেত্রে এটি তাদের ব্যাপকভাবে ভাবাবে।
আমরা আশা করব, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সময়মতো এগিয়ে এসে প্রতিবেশীদের এই অস্বস্তি দূর করবেন। আমরা আরও আশা করব, তিনি কাশ্মীরীদের রাজ্যের অধিকার, ভোটের অধিকার এবং পূর্বের বিশেষ মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে তাদের মন জয় করবেন এবং কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি বহু বছর ধরে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে চেষ্টা করেও কোনো ফল পাননি। এভাবে আর কতদিন চলবে?
আমাদের দেশে একটি উপলব্ধি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে— মোদীই ভারত নন, এবং ভারতই মোদী নয়। মহাত্মা গান্ধী স্বাধীনতার পর মুসলমানদের জানমাল রক্ষার জন্য অনশন করেছিলেন। জওহরলাল নেহরু কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের মানুষ আশা করে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পারস্পরিক সমতা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে যাবে।
সব ভারতীয়ই মোদীর এই বাধানো এই যুদ্ধকে সমর্থন করেনি। ১২ মে ভারতের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের বিরুদ্ধে মিছিল ও প্রতিবাদ হয়েছে। কলকাতায় নাগরিক মঞ্চের ডাকা যুদ্ধবিরোধী শান্তি মিছিলে অশান্তি দেখা গেছে। মোদীর দল বিজেপির সমর্থকদের বিরুদ্ধে শান্তিকামী মানুষের ওপর পেট্রোল-ডিজেল ছোঁড়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, পুলিশের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যে শান্তিকামী মানুষেরা নিজ দেশের যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে, এই যুদ্ধের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না এবং এর কোনো প্রয়োজনও ছিল না।

সূত্র: বিডি নিউজ২৪.কম