শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রয়াণ

একজন ভালোবাসাভরা মানুষের বিদায়

সাজ্জাদ শরিফ
  ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫৭

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম চলে গেলেন। চলে গেলেন আক্ষরিক অর্থেই অকালে। এই যুগে ৭৪ বছর কি বিদায় বলার মতো কোনো বয়স?
এক সপ্তাহ আগে, ৩ অক্টোবর, সৈয়দ মনজুরের যখন হার্ট অ্যাটাক হলো, তখন দেশে তিনি কার্যত একা। তাঁর একমাত্র ছেলে সাফাকাত ইসলাম বহুদিন আগেই প্রবাসে সংসার পেতেছেন। স্ত্রী সানজীদা ইসলামও অল্প কয়েক দিন হলো বিদেশে গেছেন, ছেলের সান্নিধ্যে। কিন্তু সৈয়দ মনজুর মানুষটাই এমন যে এই শহরে এবং শহরের বাইরে তাঁর শুভার্থীর শেষ নেই।
গাড়িতে করে যাওয়ার পথে তাঁর তীব্র হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। সেই ধাক্কায় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিছুক্ষণ পরে চেতনা ফিরতেই ফোনটা খুলে কোনোমতে তাঁর ড্রাইভারের হাতে দিতে পেরেছিলেন তিনি। বলেছিলেন তাঁর কয়েকজন শুভার্থীকে খবর দিতে। ব্যস, এই শুভার্থীরাই তাঁর চিকিৎসা আর পরিচর্যার সব ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। পরের একটি সপ্তাহজুড়ে এঁদের অক্লান্ত সেবা আর যত্ন কোরকের মধ্যে অস্ফুট কুঁড়ির মতো তাঁকে আবৃত করে রেখেছিল। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই ধরে রাখা গেল না।
আমার বড় ভাইয়ের কবিবন্ধুদের দলে ভিড়ে কত কত রাত যে তাঁর বাড়িতে আড্ডায় মেতেছি, অন্ন ধ্বংস করেছি। তাঁর ঠিকানা পাল্টেছে—এলিফ্যান্ট রোডে ভোজ্যতেলের গলি থেকে লালমাটিয়া, লালমাটিয়া থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলার রোডের শিক্ষক–নিবাসে। তাঁদের নতুন সংসারের একান্ত নিভৃতি তছনছ করে দেওয়া সেই আড্ডা চলেছে অবিশ্রাম।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮০–এর দশকের প্রথমার্ধে, ইত্তেফাক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক আল মুজাহিদীর দপ্তরে। আমি বিশ–বাইশ বছরের তরুণ কবি–যশোপ্রার্থী, সৈয়দ মনজুর মধ্যতিরিশ—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। প্রথম আলাপেই অবিশ্বাস্য অন্তরঙ্গতার সূত্রপাত। এরপর আমার বড় ভাইয়ের কবিবন্ধুদের দলে ভিড়ে কত কত রাত যে তাঁর বাড়িতে আড্ডায় মেতেছি, অন্ন ধ্বংস করেছি। তাঁর ঠিকানা পাল্টেছে—এলিফ্যান্ট রোডে ভোজ্যতেলের গলি থেকে লালমাটিয়া, লালমাটিয়া থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলার রোডের শিক্ষক–নিবাসে। তাঁদের নতুন সংসারের একান্ত নিভৃতি তছনছ করে দেওয়া সেই আড্ডা চলেছে অবিশ্রাম।
এই অনতিদীর্ঘ সময়ে দেখেছি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ক্রমশ বিস্তার।
তবু বিদ্যায়তনই ছিল সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের নিজের এলাকা, তাঁর প্রাণের ডানা মেলার মতো স্ফূর্তির নভোমণ্ডলী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন ইংরেজি সাহিত্য। ক্লাস নিতেন নিয়মিত, সময়মতো যেতেন। ছিলেন নিবিষ্ট শিক্ষক। গুরুগম্ভীর তো ননই; বরং খুবই প্রাণবন্ত, কৌতুকমুখর, সহজে গল্প করার মতো একজন প্রাণখোলা মানুষ। এমন শিক্ষক যাঁর সঙ্গে তর্ক করা যায়, টিপ্পনী কাটা যায়, রসিকতা করা যায়—যিনি হয়ে উঠতে পারেন ছাত্রদের অকপট বন্ধু, ছাত্রদের ভালোবাসার পাত্র।
উপন্যাসটির কিস্তি বের হতো, আর অবাক হয়ে যেতাম সৈয়দ মনজুরের তিক্ত রসিকতা, বাঁধভাঙা কল্পনা আর উদ্ভটের পারঙ্গম প্রয়োগে। ১৯৯০–এর দশকে অচেনা এক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের আবির্ভাব লক্ষ করা গেল—নতুন রকমের গল্প–বলিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে দীর্ঘ শিক্ষকতা–জীবনে অজস্র ছাত্রছাত্রী সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে, কিন্তু সৈয়দ মনজুরকে তাঁরা কখনো ছেড়ে দেননি। ক্লাসের শিক্ষক শুধু বদলে গিয়েছিলেন স্নেহভরা বন্ধুতে।
এই নিবিষ্টতা সত্ত্বেও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ক্লাসরুমের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে থাকেননি। নিজ গুণে ছড়িয়ে পড়েছিলেন বৃহত্তর পরিসরে। পড়াতেন সাহিত্য, বিশেষ আগ্রহ ছিল নন্দনতত্ত্বে। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমির সে সময়কার মহাপরিচালক মনজুরে মওলার তদারকিতে ‘ভাষা–শহীদ গ্রন্থমালা’ সিরিজে তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইয়ের শিরোনাম যে নন্দনতত্ত্ব, সেটি কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। তিনি পড়াতেন উত্তর–আধুনিকতা, উত্তর–কাঠামোবাদ ও উত্তর–উপনিবেশবাদের তত্ত্বজগৎ, তবে এর তীক্ষ্ণ সাংস্কৃতিক–রাজনৈতিক শল্যব্যবচ্ছেদে তাঁর আগ্রহ ছিল কম। তিনি ছিলেন রুচি ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ মানুষ। এসব নতুনতর ভাবনার চমকপ্রদ সৌন্দর্য সৈয়দ মনজুরকে বিমোহিত করেছিল বেশি। আর এর নিপুণ প্রকাশ ঘটেছিল প্রবন্ধ–নিবন্ধের বদলে তাঁর গল্পে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন ইংরেজি সাহিত্য। ক্লাস নিতেন নিয়মিত, সময়মতো যেতেন। ছিলেন নিবিষ্ট শিক্ষক। গুরুগম্ভীর তো ননই; বরং খুবই প্রাণবন্ত, কৌতুকমুখর, সহজে গল্প করার মতো একজন প্রাণখোলা মানুষ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন তাঁর বাবা সৈয়দ আমিরুল ইসলাম মারা যান। সেই বেদনাভরা আবেগে, ১৯৭৩ সালে, ‘বিশাল মৃত্যু’ নামে তিনি প্রথম গল্প লিখেছিলেন। তখনকার মতো সেটিই শেষ। আর লেখেননি। বহু বছর পরে গল্পে যখন আবার ফিরে এলেন, গল্প বলার ভঙ্গিটি তখন পুরো পাল্টে গেছে। মাঝখানের এই সময়টাতে তিনি পাঠক ও শিক্ষক হিসেবে সাম্প্রতিক তত্ত্ব ও সাহিত্য পড়ে ও পড়িয়ে এসেছেন।
নতুন করে তিনি গল্প বুনতে শুরু করলেন যৌথভাবে লেখা প্রথম উপন্যাসের মধ্য দিয়ে, ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে, বাংলা একটি দৈনিকে ধারাবাহিকভাবে। যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক নামে সে উপন্যাসের বড় অংশই তাঁর রচনা। উপন্যাসটির কিস্তি বের হতো, আর অবাক হয়ে যেতাম সৈয়দ মনজুরের তিক্ত রসিকতা, বাঁধভাঙা কল্পনা আর উদ্ভটের পারঙ্গম প্রয়োগে। ১৯৯০–এর দশকে অচেনা এক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের আবির্ভাব লক্ষ করা গেল—নতুন রকমের গল্প–বলিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যে বাংলা সাহিত্যের অভূতপূর্ব সুরসিক লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর নাতি, এর আগে তার লক্ষণ ধরা পড়েনি। গল্প–উপন্যাসে তা এক নতুন চেহারা নিয়ে হাজির হলো।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জীবনের শেষ কয়েকটি দিন সেই ভালোবাসার টানই দেখা গেল তাঁর শুভার্থীদের আকুল সেবাপরায়ণতার মধ্যে। এত ভালোবাসার ক্ষমতা কারই–বা আছে?
এই পথ পর্যন্ত আসার আগে সৈয়দ মনজুর কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। সাদার্ন মিসিসিপি ইউনিভার্সিটিতে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। ‘অলস দিনের হাওয়া’ নামে সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্য নিয়ে লিখে সুনাম অর্জন করেছেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ইমেরিটাস অধ্যাপক হয়েছেন। গল্প আর উপন্যাস লিখে বাংলা একাডেমি আর প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের লেখক হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। এসবের বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন সবার উপচে পড়া ভালোবাসা। এই ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন সবাইকে ভালোবাসা দিতে পারার অসামান্য ক্ষমতার কারণে। যাঁরাই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের মনে হয়েছে, সৈয়দ মনজুর তাঁকেই বিশেষভাবে ভালোবাসেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জীবনের শেষ কয়েকটি দিন সেই ভালোবাসার টানই দেখা গেল তাঁর শুভার্থীদের আকুল সেবাপরায়ণতার মধ্যে। এত ভালোবাসার ক্ষমতা কারই–বা আছে?
সূত্র: প্রথম আলো