ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার পাল্টাপাল্টি হামলা জোরদার হওয়ায় দেশ দুটির সীমান্ত–সংলগ্ন এলাকাগুলো ছাড়তে শুরু করেছেন স্থানীয় লোকজন। এরই মধ্যে অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেছেন। এ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধের আশঙ্কায় অনেকেই খাবার ও নিত্যপণ্য বেশি কিনে বাড়িতে মজুত করছেন।
গত মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ভারতের হামলার মধ্য দিয়ে দুই দেশের বর্তমান সংঘাতের শুরু। ভারতের দাবি, তারা পাকিস্তানের ‘সন্ত্রাসী আস্তানা’য় হামলা চালিয়েছে। তবে এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে পাকিস্তান।
গত ২২ এপ্রিল ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার জবাবে পাকিস্তানে ওই হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে ভারত। যদিও শুরু থেকে পেহেলগামের হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে ইসলামাবাদ।
ভারতের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি মসজিদের দৃশ্য। পাকিস্তানের লাহোরের কাছে মুরিদকে এলাকায়, ৭ মে ২০২৫
ভারতের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি মসজিদের দৃশ্য। পাকিস্তানের লাহোরের কাছে মুরিদকে এলাকায়, ৭ মে ২০২৫ছবি: রয়টার্স
এরই মধ্যে গতকাল শুক্রবার তৃতীয় দিনের মতো একে অপরের বিরুদ্ধে ড্রোন ও গোলার মাধ্যমে হামলা চালানোর অভিযোগ করেছে পারমাণবিক ক্ষমতাধর ভারত ও পাকিস্তান। প্রতিবেশী এই দুই দেশের মধ্যে এখন যে সংঘাত চলছে, তিন দশকের কাছাকাছি সময়ের মধ্যে তা সবচেয়ে বড়।
ভারতের পাঞ্জাবের বাসিন্দা অমনপ্রীত ধীল্লন। বয়স ২৬ বছর। অমনপ্রীত জানান, সীমান্ত থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে তাঁদের গ্রাম। সেখানকার অনেকেই নারী ও শিশুদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও এটা ভাবছি...আমাদের গ্রামেও হামলা হতে পারে।’
ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি জেলার কয়েকজন বলেন, সেখানকার কয়েকটি বাড়িতে গোলা পড়েছে। তাই ভয়ে অনেক পারিবার রাতের বেলা বড় পাথরের আড়ালে কিংবা বাংকারে আশ্রয় নিচ্ছেন।
উরির বারামুল্লা শহরের বাসিন্দা বশির আহমদের বয়স ৪৫ বছর ছুঁয়েছে। তিনি বলেন, ‘জীবনে কখনো এত তীব্র গোলাবর্ষণ দেখিনি। গত রাতে গোলাবর্ষণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ মানুষ শহর ও আশপাশের গ্রামগুলো ছেড়ে চলে গেছেন। কিছু মানুষ বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন।’
বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় ড্রোন হামলা চালায় ভারত। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সেসব ড্রোন প্রতিরোধ করার কথা জানানো হয়। ভারতীয় ড্রোনের কারণে লাহোরে সাইরেন বেজে উঠলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বাসিন্দারা। সেখানে অবস্থিত মার্কিন কনস্যুলেট নিজেদের কর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
গতকাল শুক্রবার লাহোরে স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানুষ খাবার, রান্নার জন্য গ্যাসের সিলিন্ডার আর ওষুধ সংগ্রহ করছেন। এ পরিস্থিতিতে কৃত্রিমভাবে দাম না বাড়াতে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
লাহোরের ৩৪ বছর বয়সী বাসিন্দা আরুশা রামিজ বলেন, ‘আমি আমার পরিবারের জন্য এক মাসের মুদিপণ্য সংগ্রহ করে রেখেছি। মাংস, আটা, চা, তেল, ডাল কিনেছি। ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত অর্থও তুলে রেখেছি।’
লাহোরে একটি ফার্মেসি চালান মোহাম্মদ আসিফ। ৩৫ বছর বয়সী আসিফ বলেন, ‘অনিশ্চিত পরিস্থিতির কারণে এখন গ্রাহক বেড়ে গেছে। অনেকেই প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে রাখছেন। এ কারণে প্যারাসিটামল, অ্যান্টি-অ্যালার্জি, অ্যান্টিবায়োটিক, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।’
অনেকটা একই রকমের পরিস্থিতি ভারতে। পাঞ্জাবের অমৃতসরের বাসিন্দা পঙ্কজ শেঠ বলেন, ‘কাল বাজার খোলা থাকবে কি না, আমরা জানি না...আমার বাড়িতে সন্তান ও নাতি-নাতনিরা আছে। তাই আমাকে কিনে রাখতে হবে।’
নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সীমান্ত–সংলগ্ন এলাকার অনেকেই আত্মীয়স্বজনের জিনিসপত্র নিয়ে যেতে অনুরোধ করছেন। অমৃতসরে নার্স হিসেবে কর্মরত নভনীত কউর বলেন, ‘আমার খালা থাকেন আটারি এলাকায়। তিনি আমাকে তাঁর জন্য আটা নিয়ে যেতে বলেছেন। কারণ, সেখানে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে।’
অমৃতসর থেকে সীমান্তবর্তী আটারির দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। নভনীত তাঁর খালার পরিবারের জন্য আটার বস্তা নিয়ে সেখানে যাচ্ছিলেন।
কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি এলাকাগুলোয় যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের ঝুঁকি আর আতঙ্ক যেন আরও বেশি। স্থানীয় লোকজন জানান, এরই মধ্যে অনেকে এলাকা ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে গেছেন। যাঁরা আছেন, রাতে গোলাবর্ষণ শুরু হলে বাংকারে চলে যান।
পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সরকারপ্রধানের কার্যালয় জানিয়েছে, নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি দুটি এলাকা থেকে চার শতাধিক মানুষকে সরকারি তত্ত্বাবধানে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
৪৩ বছর বয়সী মঞ্জুর আহমেদ থাকেন পাকিস্তানের নীলম উপত্যকার জুরা বান্দি গ্রামে। তিনি বলেন, ‘আশপাশের পাথুরে পাহাড়ে আমরা বাংকার খুঁড়েছি। মুজাফফরাবাদে ভারতের হামলার পর থেকে আমরা এসব বাংকারে থাকছি।’ স্থানীয় পুলিশও নিশ্চিত করেছে, এখানকার বেশির ভাগ মানুষ রাতে বাংকারে আশ্রয় নেন।