
পর্যটননগরী ও বাংলাদেশের চায়ের স্বর্গরাজ্য হিসেবে দেশ–বিদেশে পরিচিত শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহরের পুরান বাজারে প্রবেশ করলেই দূর থেকে চোখে পড়ে সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা এক স্থাপত্য—চুন–সুরকি দিয়ে নির্মিত আশি বছরের পুরোনো একটি দালান।
এই দালান শ্রীমঙ্গলের মানুষের কাছে শুধু একটি বাড়ি নয়; যেন এক সময়যান, যা শহরের উন্নয়ন, মানুষের গল্প, রাজনৈতিক উত্থান–পতন ও মানবিকতার ইতিহাস আজও বহন করে চলেছে।
বর্তমান সময়ে যেখানে নতুন দালানগুলো ভূমিকম্প বা সময়ের সামান্য চাপেই নড়বড়ে হয়ে পড়ে, সেখানে এখনো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভবন যেন বলে— “আমাকে শত বছরের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।”
প্রকৃতপক্ষে, স্থাপত্যশিল্পের শুদ্ধতা ও প্রকৌশলীর নিখুঁত অনুপাতে গড়া এই ভবনের প্রতিটি ইট, প্রতিটি দেয়াল এক পরিবারের ইতিহাস বহন করে। সেই পরিবার হলো শ্রীমঙ্গলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগামী ক্ষীরদ বিহারী দেব চৌধুরী এবং তাঁর পিতা রাধানাথ দেব চৌধুরীর পরিবার।
ভবনটি যে গল্প বলে
দালানটিতে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়, এটি কোনো সাধারণ পরিবারের বসতভিটা ছিল না; বরং ছিল শ্রীমঙ্গলের অভিজাত সমাজ, রাজনীতি ও শিক্ষার সমান্তরাল ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।
এখানেই নেওয়া হতো গরিব মানুষের সহায়তার সিদ্ধান্ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য জমি দানের পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রস্তুতি, সমাজসেবামূলক কর্মসূচি এবং এলাকার শান্তি ও সহমর্মিতা রক্ষার উদ্যোগ। আজও পুরোনো কাঠের দরজায় হাত দিলে যেন সেই সময়ের আলোচনার মৃদু প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
রাধানাথ দেব চৌধুরী: যার নামে রাধানগর
উনিশ শতকের শেষভাগে জন্ম নেওয়া জমিদার রাধানাথ দেব চৌধুরী ছিলেন শ্রীমঙ্গলের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক উন্নয়ন ও জমিদারি ব্যবস্থার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
তার অবদান শ্রীমঙ্গলে এতটাই ব্যাপক যে শহরের নানা দিকে তাকালেই তার উত্তরাধিকার চোখে পড়ে- চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দীনময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের (বর্তমান শ্রীমঙ্গল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) জন্য জমি দান, শ্রীমঙ্গল শহরতলির বিরামপুরে বিরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (একসময়ের রাধানাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়), নাট্যমন্দির, মন্দির ও টাউন হল প্রতিষ্ঠা ও উদ্বোধনে সহায়তা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রগামী ভূমিকা এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আজকের আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্র রাধানগর।
রাধানগরে বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানের পাঁচতারকা হোটেল, ৫০টিরও বেশি রিসোর্ট, শত কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এই উন্নয়নের পেছনের মূল ভিত্তি ছিল ব্রিটিশ আমলে তার ক্রয় করা ১৭৮ বিঘা পাহাড়ি ভূমি। তার নামেই এলাকাটির নামকরণ—রাধানগর।
এই সুরম্য দালানটির সঙ্গে সবচেয়ে গভীরভাবে যুক্ত মানুষটি হলেন ক্ষীরদ বিহারী দেব চৌধুরী। তিনি শুধু শিক্ষানুরাগী বা সমাজসেবক ছিলেন না; ছিলেন এক প্রজন্মের নীরব পথপ্রদর্শক।
তার জীবনের ক্ষেত্রসমূহ—
রাজনীতি:
কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক ও পরে ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা, একাধিকবার কারাবরণ, শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধ:
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠক হিসেবে কাজ, সভা–সমিতির মাধ্যমে তরুণদের যুদ্ধে উৎসাহ দেওয়া।
ব্যবসা ও কর্মসংস্থান:
চা–বাগান, মিল, কাঁচামাল ব্যবসা ও বিড়ি প্ল্যান্টেশন ও বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
মানবিকতা:
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে প্রতিদিন প্রায় ২০০ মানুষকে আহার প্রদান ও গরিব, ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো।
শিক্ষা ও সমাজসেবা:
স্কুল, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানে সহায়তা
অসহায় পরিবারগুলোর দায়িত্ব গ্রহণ। এই দালানের প্রতিটি ঘর ক্ষীরদ বিহারী দেব চৌধুরীর এসব কর্মকাণ্ডের স্মৃতি বহন করে।
দালানটি শুধু স্থাপনা নয়, এক যুগের দলিল:
শ্রীমঙ্গলের উন্নয়ন ইতিহাসে রাধানাথ ও ক্ষীরদ বিহারী দেব চৌধুরীর অবদান যেমন বিশাল, তেমনি এই ভবনও সেই উত্তরাধিকার বহনকারী একটি জীবন্ত স্মারক।
এটি ইতিহাসের ঘ্রাণমাখা এক স্থাপত্য,
মানুষের সেবায় নিবেদিত এক পরিবারের স্মৃতিবাহী দলিল। নির্মাণশৈলীর সময় পরীক্ষিত উদাহরণ, শ্রীমঙ্গলের সামাজিক–রাজনৈতিক স্মৃতির ভান্ডার।
আজকের দিনে ভবনটি যেমন সৌন্দর্যের উৎস, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ইতিহাস–পাঠশালা।
যারা নিজের স্বার্থ নয়, সমাজের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন, তারাই ইতিহাসে অমর হয়ে থাকেন।
ক্ষীরদ বিহারী দেব চৌধুরী ও তার পিতা রাধানাথ দেব চৌধুরীর অবদান সেই অমরত্বের প্রতীক। আর পুরান বাজারে দাঁড়িয়ে থাকা আশি বছরের এই সুরম্য দালান তদের কর্ম, অবদান ও মানবিকতার নীরব স্মারক।
যতদিন দালানটি থাকবে, ততদিন শ্রীমঙ্গলের মানুষের কাছে এক পরিবারের মানবিকতা, দানশীলতা ও ইতিহাস নির্মাণের গল্প চিরজাগরুক হয়ে থাকবে।