যে দিন আইফেল টাওয়ার বিক্রি হয়ে গিয়েছিল!

শাহাবুদ্দিন শুভ
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৩৬


আইফেল টাওয়ার—এই নাম শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে পৃথিবীর এক বিস্ময়কর প্রতীক। প্রেম, সৌন্দর্য, স্থাপত্য—সবকিছুর এক অদ্ভুত মিলন যেন এই লোহার দৈত্যের শরীরে। ফ্রান্সে এসে টাওয়ার না দেখা মানে যেন ভ্রমণটাই অপূর্ণ রয়ে গেল। আজকের যুগে তো সেলফি, দু’হাত বাড়িয়ে ছবি তোলা কিংবা টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে পোজ দেওয়া—সবই প্রায় নিয়মের মতো। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রমাণ রাখতেই হবে!
আমি-ও এর ব্যতিক্রম নই। ২০২৩ সালে প্রথমবার যখন ফ্রান্সে এসেছিলাম, তখনও একাধিকবার গিয়েছিলাম। আর এবার এখানে থিতু হওয়ার চেষ্টার সময়, আবারও যেন নতুন করে সেই পুরনো মুগ্ধতা ফিরে এল। তবে এই নভেম্বরের সফরটা ছিল একটু অন্যরকম। কারণ এইবার সঙ্গে ছিলেন আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন মানুষ—সিএম কয়েস সামি স্যার।
এক উষ্ণ মানুষের সঙ্গে শীতের প্যারিস:
স্যার আমাকে তিন মাস আগেই বলেছিলেন তিনি প্যারিসে আসবেন। অনুরোধ করেছিলেন, যতদিন থাকবেন, যেন আমি সময় বের করি। তাঁর সঙ্গে সময় কাটাতে আমার ভালোই লাগে—কারণ তাঁরা যখন কথা বলেন, তখন মনে হয় ইতিহাস আমার সামনে খুলে বসে আছে।


ব্যাংকের কাজে ঢাকায় ট্রান্সফারের পর ২০১১ সাল থেকে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আমার সরাসরি যুক্ত হওয়া, স্যোশাল মিডিয়ার পেজ তৈরি, নিউজলেটারের দায়িত্ব পালন, বিদেশে মন্ত্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান—এসবকিছুতে সবসময় ছায়ার মতো সহযোগিতা পেয়েছি সিএম তোফায়েল সামি স্যারের। সিলেটের ইতিহাস তাঁর মাথার ভেতরে যেন জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া।
আর সিএম কয়েস সামি স্যারও কম নন। পাকিস্তান আমলে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি ছিলেন ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার! পাঁচটি ব্যাংকে এমডি ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের যাত্রাও তাঁর হাত ধরেই। তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডার এমন সমৃদ্ধ যে উনার পাশে দাঁড়ালেই মনে হয়–জীবনকে নতুন করে শেখা শুরু করেছি।
প্যারিসের কুয়াশায় লুকিয়ে থাকা টাওয়ার:
সেদিন প্যারিসে প্রচণ্ড ঠান্ডা—তাপমাত্রা মাইনাসে। আমি একটু আগেই টাওয়ারের কাছে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি, টাওয়ারের অর্ধেকটাই মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল, আকাশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে সে। এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি—মনে হয়েছিল, এ যেন অন্য কোনো গ্রহ।
স্যার এসে দাঁড়াতেই প্রথম কথাই বললেন—
“জানো, একসময় একজন প্রতারক কিন্তু আইফেল টাওয়ার বিক্রি করে দিয়েছিল!”
আমি অবাক! তিনি হাসলেন, তারপর ধীরে ধীরে শুরু করলেন সেই রোমাঞ্চকর গল্প—যা পরে যাচাই করে দেখলাম, সত্যিই আছে টুর আইফেলের ওয়েবসাইটে।
যে মানুষটি আইফেল টাওয়ার ‘বিক্রি’ করেছিল:
১৯২০-এর দশকে ইউরোপ তখন যুদ্ধ-পরবর্তী অস্থিরতায় কাঁপছে। আইফেল টাওয়ার তখনো এতটা জনপ্রিয় নয়। রক্ষণাবেক্ষণে খরচ বাড়ছে, আর শহরে গুজব—টাওয়ারটা নাকি ভেঙে ফেলা হতে পারে। এই সুযোগটাই কাজে লাগালেন বিশ্বখ্যাত প্রতারক ভিক্টর লাস্টিগ।
তিনি নিজেকে ফরাসি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কয়েকজন স্ক্র্যাপ-লোহা ব্যবসায়ীর কাছে পাঠালেন গোপন চিঠি। চিঠিতে লেখা:
আইফেল টাওয়ার ভেঙে স্ক্র্যাপ লোহা হিসেবে বিক্রি করা হবে—এটি গোপন বিষয়।
তারপর প্যারিসের এক বিলাসবহুল হোটেলে আয়োজন করলেন মিথ্যা “নিলাম”। চমৎকার অভিনয়, আত্মবিশ্বাস আর মনস্তত্ত্বের খেলায় এক ব্যবসায়ী—আন্দ্রে পোয়াসঁ—৭০,০০০ ফ্রাঙ্ক দিয়ে কিনেও ফেললেন টাওয়ার!
লাস্টিগ জাল নথি দিয়ে প্যারিস থেকে উধাও। পোয়াসঁ লজ্জায় পুলিশেও যাননি। আর এই সুযোগে প্রতারক দ্বিতীয়বারও চেষ্টা করেছিলেন—তবে এবার ধরা পড়ে যান।
আবার আইফেল টাওয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে:
স্যামি স্যার সেই গল্প বলতে বলতে আমাকে নিয়ে দাঁড়ালেন টাওয়ারের ঠিক নিচে। ঠান্ডার কুয়াশা মাথায় পড়ে ঝরে পড়ছিল, আর দূর থেকে ঝকমক করছিল লোহার দৈত্যটা। মনে হচ্ছিল—সময়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। আমাদের সাথে এসময় ছিলেন হেনু মিয়া ভাই , আজাদ ভাই সহ অন্যরা।
তারপর স্যার বললেন,
“দেখো শুভ, জীবনে অনেক প্রতারণা দেখবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রতারণা হয় সেখানেই—যেখানে মানুষ সবচেয়ে কম সন্দেহ করে।” তার কথাগুলো মনে গেঁথে গেল।
শেষকথা  : এই সফর শুধু আইফেল টাওয়ার দেখা নয়—এক ভিন্ন অনুভূতির স্মৃতি। স্যারের গল্প, তাঁর সান্নিধ্য আর ইতিহাসের অজানা পাতা—সব মিলিয়ে দিনটি আমার জীবনের এক অনন্য অধ্যায় হয়ে রইল। হয়তো ভবিষ্যতে আমিও কাউকে এই গল্প শোনাব। হয়তো আরেকজন কোনোদিন আমাকে নিয়েও কিছু লিখবে। অথবা হয়তো লিখবে না।
কিন্তু আমার কাছে—
যে দিন আইফেল টাওয়ার “বিক্রি” হয়ে গিয়েছিল—সেই গল্প শুনে দেখা টাওয়ারটাই সবচেয়ে সুন্দর ছিল।
লেখক: প্রধান সম্পাদক , সিলেটপিডিয়া