অনিমা রায় যখন মেরুন রংয়ের শাড়ি, সরু শাঁখার চুড়ি আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ পরে হাজির হলেন, মনে হচ্ছিল, রবীন্দ্রনাথের আরেক নারী চরিত্র বুঝি মঞ্চে আসন গ্রহণ করছেন। সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক অনিমা রায় মঞ্চে বসার সঙ্গে সঙ্গে একটা রাবীন্দ্রিক আবহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
নিউইয়র্কে বিশেষ এক গানের সন্ধ্যা। মিশ্র কেদারা রাগে দাদরা তালের গান দিয়ে শুরু করলেন শিল্পী। গাইলেন — ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ / তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান / বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।’ শিল্পী একে একে গাইলেন ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো’, তারপর ‘বিপুল তরঙ্গ রে’। গানের ফাঁকে ফাঁকে অনিমা রায় বলছিলেন গানগুলো নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা এবং গানের পেছনের গল্পগুলো।
রবীন্দ্রনাথ মাত্র সতেরো বছর বয়সে প্রেমে পড়েছিলেন তার চেয়ে কয়েক বছরের বড় বোম্বের এক মারাঠি তরুণীর। নাম ছিল নলিনী। এই নাম অবশ্য রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। তার আসল নাম ছিল অন্নপূর্ণা। এসব চিত্র আমাদের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করল শিল্পী যখন একে এক গাইলেন, ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে’, ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি’, ‘ওযে মানে না মানা’।
বি-ফ্ল্যাটে গানটি গাইতে গাইতে শিল্পী বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক একটা গানের মধ্যদিয়ে অনেক কিছুর বার্তা দিয়েছেন। তার কোনো গান মেঘ নিয়ে, কোনো গান আকাশ নিয়ে, কোনো গান মন নিয়ে, আবার কোনো গান সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে নিয়ে। এক গানে তিনি বলেছেন অনেক কথা। যেটাকে আমরা ছোটদের গান হিসেবে জানি, সেই ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ দিয়েও তিনি পৃথিবীব্যাপী রাজনীতির অনেক দিক তুলে ধরেছেন। এই সব গল্পের কারণে অনিমা রায়ের গাওয়া আরও যেন অনুভুতিপ্রবণ করে দিয়েছিল উপস্থিত শ্রোতাদের।
সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথের সুরে সুর মিলিয়ে অনিমা আরও গাইলেন ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি তোমায়, দেখতে আমি পাইনি।’ বোঝা গেল, রবীন্দ্রগানের সাথে অনিমা রায়ের সম্পর্ক অনেক দিনের। ফাঁকে উপস্থাপক সাদিয়া খন্দকার জানালেন শিল্পীর পঁচিশ বছরের সাধনার কথা। তার গান বাছাইটাও ছিল চমৎকার। গান, গল্প আর পরিবেশনায় কাদম্বরী দেবী, আনা তড়খড়, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো সবার কথাই মনে পড়েছে একে একে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, ইউএসএ-এর আয়োজনে এই অনুষ্ঠানটিতে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের সহযোগিতাও ছিল চোখে পড়ার মতোই। মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি গান শুনেছেন সবাই। সেখানে ‘সুখের লাগি চাহে প্রেম প্রেম মেলে না’, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, ‘তোমার হরো শুরু আমার হলো সারা’, ‘এই কথাটি মনে রেখো’ গাইবার পর অনিমা সন্জিদা খাতুনের স্মরণে গাইলেন ‘কিছুই তো হলো না আর’।
উপস্থিত সকলের অনুরোধের গানের পাশাপাশি তিনি গাইলেন ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘মায়াবন বিহারীনি হরিণী’, ‘আকাশ আমায় ভড়লো আলোয় আকাশ আমি ভড়বো গানে’, ‘যদি তারে নাই চিনি গো সেকি’ এবং সবশেষে ডিএল রায় হয়ে জাতীয়সঙ্গীত। শিল্পী অনিমা রায়ের কণ্ঠে একুশটি গানের এক চমৎকার উপস্থাপনার মধ্যদিয়ে তৈরি হলো এক চমৎকার সন্ধ্যা। শিল্পীর বিস্ময় তিনি সঞ্চারিত করলেন দর্শকদের মধ্যেও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গত ৩ মে সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের আশা পার্টি হলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ইউএসএ-এর এই আয়োজনের কথা মনে থাকবে অনেক দিন। ধন্যবাদ রইল তাদের প্রতিও-যারা বাজিয়েছেন এবং আর যারা ছিলেন নেপথ্যে।v