জাপানের শ্রমবাজারে বিশাল সুযোগ: ভাষা শিক্ষায় অনীহা বড় অন্তরায়

প্রবাস ডেস্ক
  ০৯ জুন ২০২৫, ১১:১১

এশিয়ার উন্নত দেশ জাপান শ্রম রপ্তানির উন্মুক্ত বিশাল বাজার। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ১৬টি ক্যাটাগরিতে (সাধারণ শ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, কৃষিকাজ ও কেয়ার গিভারসহ) দেশটিতে শ্রম রপ্তানির বিশাল সুযোগ রয়েছে। অবারিত সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ থেকে খুবই স্বল্প সংখ্যক শ্রমিক জাপান যেতে সক্ষম হন।
বাংলাদেশ পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রমিক পাঠাতে ব্যর্থ হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভিয়েতনাম থেকে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক শ্রমিক দেশটিতে যাচ্ছেন এবং তাদের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
অভিযোগ রয়েছে দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতা ও বিগত সরকারগুলোর যথাযথ উদ্যোগের অভাবে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে শ্রম রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৮ থেকে ৩০ মে জাপান সফরকালে দেশটির সরকারের কাছ থেকে আগামী পাঁচ বছরে এক লাখ শ্রমিক পাঠানোর প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। প্রতিশ্রুতি পেলেও এ সময়ের মধ্যে এক লাখ শ্রমিক আদৌ পাঠানো সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে রিক্রুটিং এজেন্সির ব্যবসা করছেন, মীর মোহাম্মদ নাঈম নামে এমন একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে এ বিষয়ে খুঁটিনাটি দিক নিয়ে জাপান সফরে কথা বলেছেন প্রতিবেদক।
মীর মোহাম্মদ নাঈম বলেন, জাপান আসার ক্ষেত্রে শ্রমবাজারের মূল সমস্যা হলো বাংলাদেশের মানুষের আত্মবিশ্বাসের অভাব। জাপানে আসতে হলে ভাষা শিখে আসতে হবে। ভাষা শেখার ব্যাপারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মোটেই আত্মবিশ্বাস নেই। তারা মনে করেন আমরা ভাষা শিখে কী করবো, যদি ভিসা না হয়! এর জন্য ভাষা ঠিকমতো শেখেন না তারা। এটি অন্যান্য দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। যেমন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, নেপালের অসংখ্য শ্রমিক ভাষা শিখে জাপানে এসে কাজ করছেন। বর্তমানে জাপানে আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ নেপালি শ্রমিক কাজ করছেন। আর ভিয়েতনাম থেকে প্রতিবছরই চার লাখ করে সাধারণ শ্রমিক আসছেন। সেখানে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর মাত্র কয়েকশ সাধারণ শ্রমিক আসেন জাপানে।
তিনি আরও বলেন, ২০০৫ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাপান সফরে এলে জাপানের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিক নিয়ে গভমেন্ট টু গভমেন্ট (জিটুজি) চুক্তি হয়। এটি কার্যকর ছিল চার-পাঁচ বছর। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর প্রাইভেট সেক্টর খুলে দেওয়া হয়। এ কাজটি খুব সহজ ছিল না। জিটুজির আওতায় সাত বছরে মাত্র পাঁচজন জাপানে আসেন। তারপর ২০১০ সাল থেকে লোক আসতে থাকে। আমার মাধ্যমে প্রথম টেকনিকেল ট্রেনিং ভিসায় লোক আসে। আমার মাধ্যমে যত লোক এসেছে তাদের ৯০ শতাংশ এখানে এসে পালিয়ে যান। তাদের পালানোর কারণ ছিল টেকনিক্যাল ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আসলে বেতনটা কম পান তারা। বাইরে পালিয়ে গিয়ে কাজ করলে দুই-তিনগুণ বেশি বেতন পান। যদিও তাদের সঙ্গে জাপানে আসার আগে করা শর্তে বেতনের কথা উল্লেখ ছিল। তারা লোভ সামলাতে পারেননি।

শ্রমিক পাঠানোর অন্তরায়
সাক্ষাৎকারে মীর মোহাম্মদ নাঈম বলেন, বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপক সুযোগ থাকলেও প্রধানত দুটি কারণে শ্রমিক আসতে পারছে না। প্রথমত ভাষা শেখার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের অভাব ও দ্বিতীয়ত সার্টিফিকেট অব ইলিজিবিলিটি (সিওই)। অনেক সময় সিওই হওয়ার পরও বাংলাদেশের যে জাপানি দূতাবাস আছে সেখান থেকে ভিসা প্রত্যাখ্যান করে।
অভিযোগ করে তিনি বলেন, জাপানি দূতাবাসে বাংলাদেশি যারা কাজ করেন, তারা নানাভাবে ভিসাপ্রার্থীদের হয়রানি করেন। ঘুষ ছাড়া কোনো শ্রমিক যেন ভিসা না পান সেজন্য তারা নানা কূটকৌশল ও অপতৎপরতা চালান। এ সমস্যার সমাধান হলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক জাপানে আসার সুযোগ পাবেন।
মীর মোহাম্মদ নাঈম আরও বলেন, একটা লোককে যদি বলা হয় জাপান যেতে তোমার চার-পাঁচ লাখ টাকা লাগবে, কিন্তু শর্ত হলো জাপানের ভাষা শিখতে হবে (মিনিমাম এনফাইভ/এনফোর), তখনই সে প্রস্তাব দেয় আমি ভাষা শিখবো না। প্রয়োজনে আরও দুই লাখ টাকা বেশি নেন। ভাষা শেখা ছাড়া কীভাবে নেওয়া যায় সেটা একটু দেখেন। আমাদের দেশের লোকের আত্মবিশ্বাসের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। অনেকে বলে থাকেন আমি ভাষা শিখলাম দুই-তিন মাস, যদি ভিসা না হয়, আমি যদি না যেতে পারি। কিন্তু সে বুঝতে চায় না যে না যেতে পারলে তার কী এমন ক্ষতি হবে? জাপানে যারা আসতে ইচ্ছুক তাদের ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরির প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাদের বছরের পর বছর ভাষা শিখতে হবে না। জাপানে আসার জন্য একটা লোক যদি ২০০ ঘণ্টা থেকে ২৪০ ঘণ্টা ভাষা শেখেন তাহলে তার শিক্ষার লেভেল হয় এনফোর। এনফোর শিখলে তার জন্য পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, উকিনামা থেকে হোক্কাইডো পর্যন্ত জাপানে বর্তমানে এক কোটি লোকের চাকরির সুযোগ রয়েছে। এখানে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্রমিকের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। কিউউশেরিয়া, নাগাসাকি, ইকিমোমত, ঐকা- এসব এলাকায় অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক কৃষি আবাদি জমি ফাঁকা পড়ে আছে। শুধু কেয়ারগিভার, কৃষি কিংবা নির্মাণকাজের শ্রমিক নয়, প্রতিটি সেক্টরের তাদের শ্রমিক সংকট রয়েছে। এক্ষেত্রে এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের দেশের লোকদের ভাষা শিক্ষার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, জাপানের কিছু ম্যানার শেখাতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাপানি দূতাবাস কিংবা জাপানের সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তির নামে যদি সার্টিফিকেট অব ইলিজিবিলিটি (সিওই) বের হয় তাহলে কোনো প্রকার সমস্যা ছাড়া যেন সে ভিসা পায় এবং জাপানে আসতে পারে সেটি দেখতে হবে।
নাঈম জানান, সার্টিফিকেট অফ ইলিজিবিলিটি দেয় টোকিও ইমিগ্রেশন। এখানে দুই নম্বরি হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। তাদের ৫০ হাজার ডলার ঘুষ দিয়েও কোনো অবৈধ কাজ করানো যাবে না। কোনো ব্যক্তির নামে সিওই হওয়ার পর সেই ব্যক্তি জাপান দূতাবাসে আবেদন করে। তখন দূতাবাস তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের মাধ্যমে তার দেওয়া তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। সেক্ষেত্রে তাদের মনোনীত ব্যক্তিরা ঘুষ পেলে সিওই ঠিক আছে বলে মতামত দেন অন্যথায় নেতিবাচক মতামত দেন। নেপাল, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে আমি অনেক শ্রমিক এনেছি। আজ পর্যন্ত আমি শুনিনি সিওই পাওয়ার পর কারও ভিসা হয়নি।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, জাপান দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ভিএফএস নামক যে প্রতিষ্ঠানটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের কারও যোগাযোগ রয়েছে। দূতাবাস থেকে যার নামে সিওই হয়েছে তার আবেদনপত্রের নম্বর সেখানে দিয়ে দেওয়া হয়। অনেকের মুখেই শুনেছি, আবেদনকারীর কাছে মোবাইলে যোগাযোগ করে বলা হয় আপনি কি জাপানি ভিসার জন্য আবেদন করেছেন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ভিসা দ্রুত হয়ে যাবে, না হলে ভিসা পেতে সমস্যা হবে। সরকারকে এই বিষয়ে নজর দিতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
শুধু শ্রমিক নয়, আইটি-ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখানে কাজের সুযোগ রয়েছে। যারা আসছেন তারা খুব ভালো অবস্থানে রয়েছেন বলে তিনি জানান।