
নিউইয়র্কের কুইন্সের ওজন পার্ক এলাকায় উইন রোজারিও নামের উনিশ বছর বয়সি বাংলাদেশি আমেরিকান যুবকের হত্যাকাণ্ড ঘিরে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ২০২৪ সালের সাতাশ মার্চ নিজের বাড়িতেই মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে থাকা অবস্থায় তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হন। পরিবারের সদস্যরা ঘটনাস্থলেই ছিলেন, আর পুলিশের দেহে থাকা ক্যামেরার ভিডিওতে পুরো ঘটনাই ধরা পড়ে।
প্রায় দেড় বছরের তদন্তের পর ২০২৫ সালের চার ডিসেম্বর রাজ্য অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিসিয়া জেমসের অধীনে থাকা বিশেষ তদন্তকারী বিভাগ ঘোষণা করে যে ঘটনায় জড়িত দুই পুলিশ কর্মকর্তা — ম্যাথিউ সিয়ানফ্রকো এবং সালভাতোরে আলঙ্গির বিরুদ্ধে কোন অপরাধমূলক অভিযোগ আনা হবে না। তদন্তকারীরা জানান, ঘটনাটিকে বেআইনি বলপ্রয়োগ প্রমাণ করার মতো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। তাদের মতে, কর্মকর্তারা আইন অনুযায়ী কাজ করেছেন কি না, তা “সন্দেহাতীতভাবে” ভুল প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসে উইন রোজারিও হত্যাকাণ্ডের দেড় বছর পর গত সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি) আনুষ্ঠানিকভাবে সিভিলিয়ান কমপ্লেইন্ট রিভিউ বোর্ডের (সিসিআরবি) আনা অসদাচরণের অভিযোগ কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
সিসিআরবি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, কর্মকর্তারা গুরুতর অসদাচরণ করেছেন—অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তবে শাস্তিমূলক প্রক্রিয়া শুরু হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। উইন রোজারিওর পরিবার, জাস্টিস কমিটি, ডেসিস রাইজিং আপ অ্যান্ড মুভিং (DRUM) সহ বিভিন্ন সংগঠন এনওয়াইপিডি সদর দপ্তরের সামনে সেসময় বিক্ষোভ করেন। প্রায় চল্লিশজন প্রতিনিধি কমিশনার জেসিকা টিশ ও মেয়র এরিক অ্যাডামসকে চিঠি দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান জানান। অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল।
উইনের মা নোতান ইভা কস্তা বলেছিলেন, “অবশেষে অভিযোগ হস্তান্তর হওয়ায় আমি স্বস্তি বোধ করছি, কিন্তু এটা পেতে আমাদের এত লড়াই করতে হয়েছে। দুই পুলিশ অফিসারকে অনেক আগেই বরখাস্ত করা উচিত ছিল। আমি আশা করি এনওয়াইপিডি আর বিলম্ব করবে না এবং দ্রুত তাদের বরখাস্ত করবে। উইন ছাড়া এই দেড় বছর আমি আমার এক অংশ হারিয়েছি।”
নাগরিক অধিকার সংগঠন ড্রামের বাংলাদেশি সংগঠক কাজী ফৌজিয়া জানিয়েছিলেন রোজারিও পরিবারকে নিয়ে সিসিআরবি’র শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। পরিবারের পাশাপাশি ড্রামের মেম্বাররাও শুনানিতে কথা বলেছেন। রোজারিওর জন্য শুনানিতে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা জানিয়ে কাজী ফৌজিয়া জানিয়েছিলেন বোর্ড আমাদের পক্ষে রায় দেয়, যা আমাদের মনোবল বাড়িয়েছে। আমরা চাই এই রায় দ্রুত কার্যকর হোক।”
এখন রাজ্য অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিসিয়া জেমসের অধীনে থাকা বিশেষ তদন্তকারী বিভাগ ঘোষণা করে যে ঘটনায় জড়িত দুই পুলিশ কর্মকর্তা — ম্যাথিউ সিয়ানফ্রকো এবং সালভাতোরে আলঙ্গির বিরুদ্ধে কোন অপরাধমূলক অভিযোগ আনা হবে না।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পরপরই নিহতের পরিবার, অধিকারকর্মী, কমিউনিটি সংগঠন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করা মানুষজন গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের বক্তব্য, এই সিদ্ধান্ত ন্যায়বিচারকে দুর্বল করেছে এবং পুলিশের হাতে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনাকে আরও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
আইনগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগ সেই ক্ষেত্রে বৈধ গণ্য হয়, যখন পুলিশ বিশ্বাস করে যে তাদের জীবন বা অন্যের জীবন তাৎক্ষণিক বিপদে। বিশেষ তদন্তকারী বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মকর্তারা সতর্কতা দিয়েছিলেন, টেজার ব্যবহার করেছিলেন, এবং পরিস্থিতি উত্তেজিত হওয়ার পর তারা আইনসঙ্গতভাবে বলপ্রয়োগ করেছেন বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে। যদিও ভিডিও তা প্রমাণ করে না। একহাতে ট্রেজার ধরে, অন্যহাতে একের পর এক গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে উইন রোজারিওর।
এটর্নি জেনারেলের এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই “কাগজ–কলমের যুক্তি” বলে মনে করছেন। তাদের মতে, মানসিক সংকটে থাকা একজন তরুণের সামনে পুলিশের পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর্মী পাঠানো উচিত ছিল। পরিবারের দাবি, পুলিশ বাড়িতে এসে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে, তাতে তাদের ছেলেকে হারাতে হয়েছে।
নিহতের মা, বাবা ও ভাই একটি যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত যেন তাদের ছেলে আরেকবার হত্যা হওয়া দেখার মতো। তাদের অভিযোগ, দুই কর্মকর্তা বাড়িতে ঢুকে চিৎকার, অশ্রাব্য ভাষা ও হুমকিমূলক আচরণ করেন এবং মাত্র দুই মিনিটের মধ্যেই টেজার ও গুলি চালান। তারা বলেন, যদি পরিবারের কোনো সদস্য এমন কিছু করতো, তবে সেই মুহূর্তেই গ্রেপ্তার হতো, কিন্তু পুলিশ তা করেও শাস্তি পাচ্ছে না।
পরিবার আরও অভিযোগ করে যে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস দীর্ঘ সময় ধরে তাদের কোন আপডেট দেয়নি এবং যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে তা পরিবারের বক্তব্য ও ভিডিওর সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। তারা পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বিচার শুরুর আহ্বান জানিয়েছে এবং দুই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার দাবি তুলেছে।
অধিকারকর্মীরাও বলছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে পুলিশের জবাবদিহি আরও দুর্বল হলো। তাদের মতে, সমাজের মানসিক সংকট, দারিদ্র্য, অভিবাসী সম্প্রদায়ের ঝুঁকি ও সামাজিক সহায়তার অভাবে পুলিশের ওপর নির্ভরশীলতার ফলে এমন মৃত্যুই ঘটছে। বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলেছেন, এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং পুলিশি আচরণে দীর্ঘদিনের বেপরোয়া প্রবণতার প্রতিফলন।
কমিউনিটি সংগঠনগুলির মধ্যে অনেকে এই সিদ্ধান্তকে লজ্জাজনক বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং বলছেন, যদি এই ধরনের ঘটনারও শাস্তি না হয়, তবে “দায়বদ্ধতা” শব্দটিই অর্থহীন হয়ে পড়বে। তাদের মতে, পুলিশের হাতে মৃত্যু ঘটলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রায়শই ঘটনাকে আড়াল করে রাখে।
উইন রোজারিওর মৃত্যু, পুলিশের ভূমিকা এবং তদন্তের সিদ্ধান্ত—এই সবকিছুই নিউইয়র্কে মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের সময় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, সে বিষয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। সমাজের অনেকেই বলছেন, মানবিক সহায়তার পরিবর্তে অস্ত্রধারী বাহিনী হাজির হলে বিপর্যয়ই ঘটে।
পরিবারের আহ্বান—ন্যায়বিচারের পথ দীর্ঘ হলেও তারা থামবেন না। তারা চান পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক এবং মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়ায় পুলিশের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করা হোক। তাদের ভাষায়, “উইন আর ফিরে আসবে না, কিন্তু আমাদের লড়াই থামবে না। নিউইয়র্কের মানুষের জন্য আরও নিরাপদ ও মানবিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই এই লড়াই।”
নাগরিক সংগঠক কাজী ফৌজিয়া জানিয়েছেন, তারা অ্যাটর্নি জেনারেলের এমন সিদ্ধান্তকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেবেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল নিজে যখন আইনি সমস্যায় পড়েছিলেন, কমিউনিটি তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এখন তিনি হত্যাকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের ছাড় দিচ্ছেন—এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন বিষয়টি তারা নিউইয়র্কের প্রতিটি নাগরিকের কাছে তুলে ধরে সুবিচারের দাবি জানাবেন।