গ্রীষ্মকাল মানেই যেন নিউইয়র্কের পার্কগুলোতে বাংলা গানের সুর, লুচি-চানাচুরের গন্ধ আর ঘুড়ির রঙিন ওড়াউড়ি! যেন মুহূর্তেই বদলে যায় প্রবাসজীবনের চেনা ছক। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি কমিউনিটির জন্য এই সময়টা শুধুই বিনোদনের নয়, বরং শিকড়ের টানে ফিরে যাওয়ার এক বিশেষ উপলক্ষ।
বছরের পর বছর ধরে এই বনভোজনগুলো প্রবাসজীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। প্রখর রোদ্দুরের মাঝে আয়োজিত একদিনের এই মিলনমেলা যেন হয়ে ওঠে গ্রামবাংলার হারানো স্মৃতির পুনরুজ্জীবন। ভোর থেকে পার্কে হাজির হন সবাই। কেউ ঘুড়ি ওড়ান, কেউ হ্যান্ডবল খেলেন, কেউবা রান্নার তদারকিতে ব্যস্ত। দুপুরে শুরু হয় বাঙালি পদের ভোজ। তরকারি, খিচুড়ি, গরুর মাংস, রসগোল্লা আর নানান ঘরোয়া খাবারে মুখর থাকে সারি সারি তাঁবু। তারপর একে একে শুরু হয় গান, কবিতা, নাটক আর ছোটদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে শুরু করে টেক্সাস, জর্জিয়া বা মিনেসোটার হরেক রকমের ফুলে ভরা এসব উদ্যান রূপ নেয় বাংলার রঙিন মেলায়। আয়োজন চলে রান্নাবান্না, নাচগান, খেলা, আর অজস্র আড্ডা। সারাদিন বাংলা সংস্কৃতির এক জীবন্ত চিত্র ফুটে ওঠে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও সামাজি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের বনভোজনে।
এই গ্রীস্মেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি কমিউনিটি মেতে উঠেছেন গ্রীষ্মের বনভোজনে। সম্প্রতি নিউইয়র্কের হেকশার স্টেট পার্কে বনভোজনের আয়োজন করে আমেরিকান বাংলাদেশি কমিউনিটি হেল্প গ্রুপ, নিউইয়র্কের হেমপস্টেড লেক স্টেট পার্কে দোহার উপজেলা সমিতি, সানকেন মিডো স্টেট পার্কে আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব। এছাড়া চিটাগাং এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন অব মিশিগান, মাদারীপুর জেলা সমিতিসহ অসংখ্য সংগঠনের বনভোজন চোখে পড়ে। একদিনের এই মিলনমেলা যেন শিকড়ে ফেরার ডাক।
বনভোজনের আরেক দিক হলো এটি একধরনের নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম। অনেক ছোট ব্যবসা, হোম বেইজড খাবারের উদ্যোগ, বিউটি পণ্য কিংবা বইয়ের দোকান এসব ইভেন্টে অস্থায়ী স্টল দেয়। এতে একদিকে পরিচিতি বাড়ে, অন্যদিকে কমিউনিটি-ভিত্তিক অর্থনৈতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে।
শুধু বড়রা নন, তরুণ প্রজন্মও এসব আয়োজনে এগিয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের দল নিজেরাই পুরো অনুষ্ঠান সাজায়, পরিচালনা করে ক্যাম্প, রাফেল ড্র ও মঞ্চের পরিবেশনা। কেউ গান গায়, কেউ আবৃত্তি করে, আবার কেউ স্টল দেয় নিজ হাতে তৈরি খাবার কিংবা পণ্যের। বনভোজন তাই হয়ে ওঠে একধরনের কমিউনিটি নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্মও।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাংলা অক্ষর শেখে। নাচে অংশ নেয়, কেউ কেউ আবৃত্তি করে। যেন তারা অজান্তেই ধারণ করছে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির শেকড়। অনেক সংগঠন এদিন আয়োজন করে বাংলা শেখার ওয়ার্কশপ কিংবা ঐতিহ্যবাহী খেলার প্রতিযোগিতা। এতে মা-বাবারাও সন্তুষ্ট। কারণ তারা চান সন্তানদের হৃদয়ে যেন বাংলাদেশি পরিচয় গেঁথে থাকে।
প্রবাসী শফিকুল আলম বলেন, এত কিছুর মাঝে বনভোজনের সত্যিকারের তাৎপর্য যেন সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায় সম্পর্কের টানে। এই একদিনে পরিচয় হয় বহু নতুন মুখের। পুরোনো বন্ধুত্ব ফিরে আসে, গড়ে ওঠে পরস্পরের প্রতি নির্ভরতার বন্ধন। প্রবাসজীবনের একঘেয়েমি ভেঙে যে অনুভূতিটা ফিরে আসে, তা শুধুই বাংলা ভাষা বা খাবার নয় বরং একটুখানি আত্মপরিচয়ের স্পর্শ।
কমিউনিটির প্রবীণ সদস্যরা বলেন, এটা শুধু একদিনের আনন্দ নয়, বরং প্রবাসজীবনের ক্লান্তি, শূন্যতা আর বিচ্ছিন্নতাকে মুছে দেওয়ার এক আন্তরিক প্রয়াস। সাবেক শিক্ষক রওশন আরা জানান, আমরা এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও এই বনভোজনের দিনটায় মনে হয় আমরা সবাই একসঙ্গে বাংলার বুকেই আছি।
নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসের নাজমুল হক বলেন, গ্রীষ্মকাল এলেই মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। বনভোজনের ডাক মানেই শিকড়ের টান। কাজের ব্যস্ততার মাঝে এই একটা দিন যেন জীবনের জ্বালানির মতো। এখানে এসে বাংলা গান শুনলে চোখ ভিজে আসে, মনে হয়। বাংলাদেশ তো এখানেই আছে।
নিউজার্সির প্রবাসী ও দুই সন্তানের মা সাবিহা রহমান বলেন, আমি চাই, আমার ছেলেমেয়েরা জানুক তারা কারা, কোথা থেকে এসেছে। বনভোজনে ওদের যখন দেখি বাংলা নাচ বা আবৃত্তিতে অংশ নিচ্ছে, তখন মনে হয়—আমার ছোটবেলাটাও আবার ফিরে এসেছে।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি প্রবাসীদের সংখ্যা বর্তমানে আনুমানিক ৮ থেকে ১০ লাখের মতো ধারণা করা হয়। যা প্রতি বছর ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রধানত নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ক্যালিফোর্নিয়া, ম্যাসাচুসেটস, টেক্সাস ও জর্জিয়াসহ বড় বড় শহরগুলোতে বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল গড়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স, ব্রঙ্কস, ব্রুকলিন এবং নিউজার্সির এলিজাবেথ, জার্সি সিটি এসব এলাকা বাঙালিদের ঘনত্ব বেশি।
এসব এলাকায় প্রবাসী বাঙালিদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় চেতনা ধরে রাখতে বিভিন্ন সংগঠন সক্রিয়। সংগঠনগুলো প্রবাসীদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা বৃদ্ধি করে, পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করাতে কাজ করে। এইভাবে তারা প্রবাসে বাঙালি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ়করণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বনভোজনের মতো আয়োজনগুলো সেই মিলনমেলার অন্যতম প্রতীক। যা প্রবাসী জীবনের একাকীত্ব দূর করে নতুন করে শিকড়ের টান জাগিয়ে তোলে।